শুক্রবার, ৫ মার্চ, ২০১০

জীবাণুু সার : বাঁচাবে দু'হাজার কোটি টাকার ইউরিয়া

দেশে এ বছর ২৯ লক্ষ ৫০ হাজার মেট্টিক টন ইউরিয়া সারের চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে ভর্তুকি দিয়ে উৎপাদন হবে ১৭ লক্ষ মেট্টিক টন। বাকি ১২ লাখ ৫০ হাজার মেট্টিক টন বিদেশ থেকে আমদানি করা হবে। ইউরিয়া সাশ্রয়ের জন্য ডাল, তেল, শিমজাতীয় ফসল ও ধানে ইউরিয়ার পরিবর্তে জীবাণু সার ব্যবহার করা গেলে দুই হাজার কোটি টাকার ইউরিয়া সাশ্রয় হবে।
বাংলাদেশে জীবাণু সার বিষয়ক গবেষণা শুরম্ন হয় ১৯৩৯ সালে। বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা ১৯৭১ থেকে ৭৩ সালে ১৩টি শস্যের রাইজোবিয়াম ব্যাকটেরিয়া পৃথকীকরণের কাজ করেন। ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ সয়াবিন শস্যের পিটমাটিভিত্তিক জীবাণু সার তৈরি করে। ১৯৬৮ সালে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাজোটোব্যাকটার নিয়ে কাজ শুরম্ন করলেও বিসিআইসি থেকে কয়েকটি স্ট্রেইন এনে ১৯৮১ সাল থেকে জীবাণু সার বাণিজ্যিকভাবে তৈরি শুরম্ন করে। বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ১৯৮৮ সালে প্রথম কৃষকের মাঠে সফলভাবে জীবাণু সারের প্রদর্শনী স্থাপন করে। এছাড়াও বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (১৯৭৭), বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (১৯৮০), বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (১৯৮০) গবেষণা শুরম্ন করে।
জীবাণু দিয়ে তৈরিকৃত সারই হচ্ছে জীবাণু সার। গত ৩৬ বছর ধরে এদেশে জীবাণু সারের উপর গবেষণা হলেও আজ পর্যনত্ম এ সার কৃষকের দোরগোড়ায় পেঁৗছায়নি। এ সার শুধু ডালজাতীয় ফসল এবং চীনাবাদামে ব্যবহার হয়। বাংলাদেশের কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তর ও শস্যবহুমুখীকরণ কর্মসূচির আওতায় জমিতে সংশিস্নষ্ট ফসলে জীবাণু সার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল। বাংলাদেশে প্রথমবারের মত এ কে খান এন্ড কোং এর সাথে বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের একটি চুক্তি হয়েছিল জীবাণু সার বাজারজাত করার জন্য। কৃষি মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনে এই চুক্তিতে কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তর সহায়তা করেছিল। কিন্তু দেড় বছর পরই কর্মসূচিটি বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কারণে বন্ধ হয়ে যায়।
বাংলাদেশে ব্যবহার করলে জীবাণু সারের চাহিদা হবে ১ হাজার টন। যেহেতু এই সারের দাম কম ও অল্প পরিমাণ লাগে তাই বছরে ২০০০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে। এর প্রধান কাঁচামাল বাতাসের নাইট্রোজেন ও পিটমাটি বলে এটি ব্যাপক পরিমাণে উৎপাদন সম্ভব। এ দু'টো আমাদের দেশে প্রচুর আছে। পিটমাটি আছে ৬ লক্ষ হেক্টর জায়গায়। এর উৎপাদন খরচও খুব কম। রাইজোবিয়াম ব্যাকটেরিয়া জীবাণু সার উৎপাদনে লাগে। উলেস্নখ্য, মোট জীবাণুর শতকরা ৯৫ ভাগ জীবাণুই উপকারী বাকি ৫ ভাগ ক্ষতিকর।
উপকারীতা : শস্যের ফলন বৃদ্ধি : রাজোবিয়াল জীবাণু সার বাতাসের নাইট্রোজেন সংবন্ধনের মাধ্যমে ইউরিয়া সারের চেয়ে ডাল শিম জাতীয় শস্য ও চীনাবাদামে ফলন বৃদ্ধি করে। যেমন_ মসুর ১৫-৪০%, ছোলা ২০-৪৫%, মুগ ১৮-৩৫%, বরবটি ১৮-৩৫%, খেসারি ২৫-৪৫%, মাসকলাই ২০-৩৫%, মটর ৩০-৪৫%, অড়হর ২০-২৫%, ধৈঞ্চা ৪০-৮০, চীনাবাদাম ২০-৪%, সয়াবিন ৭৫-২০০% ফলন বৃদ্ধি করে। শস্যের আমিষ বৃদ্ধি করে : জীবাণু সার ব্যবহারে গড়ে শতকরা ২০ থেকে ১৫০ ভাগ আমিষ শস্যে বৃদ্ধি পায়। মাটির গুণাগুণ বৃদ্ধি করে : বাতাসের নাইট্রোজেন রাইজোবিয়াম মূলের গুটিতে জমা করে মাটিও এতে উপকৃত হয়। অপরদিকে রাসায়নিক সার মাটির গুণাগুণ নষ্ট করে। পরিবেশ সহায়ক : জীবাণু সার সম্পূর্ণ পরিবেশসম্মত। অন্যদিকে রাসায়নিক সার মাটি, পানি, বায়ু ও মানুষের জন্য ক্ষতিকর। উৎপাদন খরচ কম : সমপরিমাণ ইউরিয়া ও জীবাণু সার ব্যবহারে খরচ পড়ে যথাক্রমে ৫৫০ টাকা ও ১১০ টাকা। পরবর্তী ফসলের জন্য ইতিবাচক প্রভাব পড়ে : ইউরিয়া প্রয়োগের ক'দিনের মধ্যেই এর প্রভাব শেষ হয়ে যায়। কিন্তু জীবাণু সারের জৈবিক নাইট্রোজেন মাটিতে থেকে যায় যা পরবর্তী ফসলে কাজে লাগে। অপচয় রোধ : ইউরিয়া সারের ৪০ থেকে ৬০ ভাগ উদ্ভিদের কাজে লাগে। বাকি অপচয় হয়। কিন্তু জীবাণু সারের প্রায় সবই কাজে লাগে।
বাতাস থেকে নাইট্রোজেন সংবন্ধন হয় (৭০ দিনে) প্রতি হেক্টরে মসুর ১১৫ কেজি, ছোলা ১০৫ কেজি, মাসকলাই ১০০ কেজি, খেসারি ৯৫ কেজি, মটর ১১০ কেজি, অড়হর ২০০ কেজি, বরবটি ১০০ কেজি, চীনাবাদাম ১৫০ কেজি, সয়াবিন ২১০ কেজি।
বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট বর্তমানে ৬টি শস্য যেমন_ মসুর, ছোলা, বরবটি, মুগ, চীনাবাদাম, সয়াবিনের জীবাণু সার উৎপাদন করছে।
সীমাবদ্ধতা : সাধারণ সারের চেয়ে এই সার উৎপাদন, সংরক্ষণ, বাজারজাতকরণ, ব্যবহার ইত্যাদি ক্ষেত্রে বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। যেমন_ উৎপাদনের সময় স্ট্রেইন চিহ্নিত করতে হচ্ছে সূক্ষ্মভাবে, প্রয়োজনীয় সংখ্যক জীবিত রাইজোবিয়াম প্যাকেটে দিতে হবে, ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিম্ন তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করতে হবে। তবে ২৫ থেকে ৩০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় ৯০ দিন পর্যনত্ম সংরক্ষণ করা যায়, তাপমাত্রা বেশি ও রোদ পড়লে জীবাণু মারা যায় তাই সারের কার্যকারিতা থাকে না, প্রয়োগের সঠিক নিয়ম না মানলে জীবাণু মারা যায় ও জীবাণু সার প্রয়োগকৃত শস্যের চাষাবাদ জলবায়ুসহ বিভিন্ন কারণে কমে যাচ্ছে। ফলে জীবাণু সার ব্যবহারের চাহিদাও কমে যাচ্ছে।
ব্যবহার বিধি : বীজ ১ কেজি, জীবাণু সার ৫০ গ্রাম, চিটাগুড় ৫০ গ্রাম হারে পলিথিন বা পস্নাস্টিকের গামলা নিয়ে মেশাতে হবে। বীজ আগে চিটাগুড় দিয়ে মিশিয়ে পরে জীবাণু সার দিয়ে মেশাতে হবে। চিটাগুড় না থাকলে ঠা-া ভাতের মাড় দিয়ে কাজটি করা যাবে। সাধারণ ছোট বীজে ৩ থেকে ৫%, বড় বীজে ২ থেকে ৩% জীবাণু সার ও চিটাগুড় দিতে হয়। এতে বীজের গায়ে একটু কালো প্রলেপ পড়ে। বীজ পরস্পর লেগে থাকলে একটু ছায়ায় রাখলেই হবে।
জীবাণু সার মেশানোর পরপরই মাঠে বপন করে সাথে সাথে মাটির ভেতরে ঢেকে দিতে হবে। বপনের সময় হচ্ছে সকাল ৯টার আগে এবং বিকাল ৪টার পরে।
সতর্কতা : কোন অবস্থায়ই জীবাণু সারে রোদ ও তাপ লাগতে দেয়া যাবে না। রোদ ও তাপ লাগলেই বুঝতে হবে জীবাণু মারা গেছে। ওই সারের কার্যকারিতা নষ্ট হয়েছে। এজন্য ঠাণ্ডা জায়গায় রাখতে হবে এবং প্রয়োগের পরও খেয়াল রাখতে হবে।
জীবাণুসমূহের প্রকারভেদ : ইউরিয়ার বিকল্প : শিম ও ডালজাতীয় শস্যের জন্য রাইজোবিয়াম/ব্রাডিরাইজোরিয়াম (ব্যাকটেরিয়া)। ধানের জন্য এ্যাজোলা, অ্যাজেটোব্যাক্টার, নীল সবুজ শেওলা ও এজোস্পাইরিয়াম ইত্যাদি।
টিএসপির বিকল্প : জীবাণু ব্যাসিলাস, সিওডোমোনাস, পেনিসিলিয়াম, গেস্নামস ইত্যাদি।
বর্তমানে বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) ব্যাপকভাবে ৬টি জীবাণু সার উৎপাদনের কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। গত কয়েক বছরে প্রায় ১৫ হাজার প্রদর্শনী পস্নট করা হয়েছে। জীবাণু সারের সুফল কৃষকের কাছে পেঁৗছানোর জন্যে কৃষি উপ-পরিচালক, কৃষি কর্মকর্তা, কৃষি সমপ্রাসরণ কর্মকর্তা, কৃষি বিজ্ঞানী, উপ সহকারী কৃষি কর্মকর্তা ও কৃষকদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে।
জীবাণু সারের কোন পাশর্্বপ্রতিক্রিয়া নেই। বিনা'র কৃষি বিজ্ঞানী ড. নিয়াজ পাশা জানান, জীবাণু সার কৃষকের কাছে পেঁৗছানোর জন্য প্রদর্শনী পস্নট করা হচ্ছে। কৃষক, কৃষিকর্মী ও কৃষি কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ ছাড়াও সরকারি উদ্যোগে রেডিও, টেলিভিশন, পত্রপত্রিকায় এর প্রচারের ব্যবস্থা করলে কৃষকের কাছে জনপ্রিয় হবে। _কৃষিবিদ ফরহাদ আহম্মেদ, টাঙ্গাইল

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন