রবিবার, ৭ মার্চ, ২০১০

হলুদ ও মরিচের সাথে তুলা চাষ

মানব সভ্যতার শুরু থেকেই কাপড়ের ব্যবহার হয়ে আসছে। এই কাপড়ের প্রধান উপাদান হল তুলা। তুলা উৎপাদনে বাংলাদেশের গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্য থাকলেও ঔপনিবেশিক শাসনামলে বিশ্বখ্যাত মসলিনসহ উন্নতমানের বস্ত্র উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাড়া দেশের অন্যতম প্রধান এলাকায় তুলাচাষ বিলুপ্ত হয়ে যায়। পার্বত্য চট্টগ্রামের উৎপাদিত পাহাড়ি তুলার অাঁশ খাটো এবং মোটা হওয়ার কারণে তা আধুনিক বস্ত্রশিল্প থেকে বাদ পড়ে। আর সে কারণেই বস্ত্রশিল্প সম্পূর্ণ আমদানি নির্ভর হয়ে পড়ে। স্বাধীনতার পর কাঁচা তুলার অভাবে দেশের বস্ত্রশিল্প মারাত্মক সংকটের মুখোমুখি হয়। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সরকার সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপ হিসেবে দেশে আমেরিকান জাতের তুলা চাষের প্রবর্তন ও সমপ্রসারণের জন্য ১৯৭২ সালে তুলা উন্নয়ন বোর্ড গঠন করে। ১৯৯১ সাল থেকে তুলা উন্নয়ন বোর্ড তুলার বিভিন্ন বিষয়ের ওপর গবেষণা পরিচালনা করে আসছে।
তুলা উন্নয়ন বোর্ডের ৫টি গবেষণা কেন্দ্রে_ প্রজনন, কৃষিতত্ত্ব, মৃত্তিকা বিজ্ঞান, কীটতত্ত্ব ও রোগতত্ত্ব ডিসিপ্লিনে আমেরিকান তুলার ২০টি ও পাহাড়ি তুলার ওপর ১৩টি গবেষণা কার্যক্রম বাস-বায়ন করা হয়েছে। এ ছাড়াও দেশের বিভিন্ন জোনে মোট ২২টি অন-ফার্ম ট্রায়াল স্থাপন করা হয়েছে। বর্তমানে দেশে কাঁচা তুলার চাহিদা রয়েছে প্রায় ১৫ লক্ষ বেল। সেখানে দেশে উৎপাদন হয় মাত্র ১ লক্ষ বেল। বাকি ১৪ লক্ষ বেল দেশের চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে প্রতি বছর বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। দেশে উৎপাদিত তুলা দিয়ে এ চাহিদার শতকরা ৭ থেকে ৮ ভাগ পূরণের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে তুলা গবেষণা, বীজ উৎপাদন ও বিতরণ, বাজারজাতকরণ ও জিনিং এবং সমপ্রসারণের ব্যাপক কর্মসূচি সরকার গ্রহণ করেছে। আরো আশার কথা হচ্ছে দেশের বিভিন্ন জেলাতে বর্তমানে সাথী ফসল হিসেবে তুলার চাষ শুরু হয়েছে। তবে উন্নতজাতের হাইব্রিড বীজের দুষপ্রাপ্যতা ও উচ্চমূল্যের কারণে তুলা চাষিরা রীতিমত দিশেহারা।
তুলার বাজারমূল্য নিয়েও তারা শংকিত। এবছর তুলা উন্নয়ন বোর্ড কুষ্টিয়া জোনের অধীন রাজবাড়ী জেলার বালিয়াকান্দি ও জামালপুর ইউনিটের আওতায় ২৪৭ হেক্টর জমিতে তুলার চাষ হচ্ছে। এর সাথে প্রায় ১১শ' কৃষক সরাসরি সম্পৃক্ত রয়েছে। গত বছর দেশীয় জাতের তুলার আবাদ করে পোকার আক্রমণসহ আশানুরূপ ফলন না পেয়ে অনেকেই এবার নতুন করে হাইব্রিডজাতের তুলার আবাদ শুরু করেছে। চায়না থেকে আমদানিকৃত প্রতি কেজি এ তুলা বীজের বাজারমূল্য প্রায় ২ হাজার টাকা। অথচ সরকারিভাবে সরবরাহকৃত সাধারণ জাতের তুলা বীজের প্রতি কেজি বাজার মূল্য মাত্র ১৫ টাকা। দেশীয় এবং হাইব্রিডজাতের বীজের এই আকাশচুম্বী ব্যবধান ও দুষপ্রাপ্যতার কারণে লাভজনক তুলা চাষে আগ্রহী অনেক চাষিই এখন দিশেহারা।
মরিচ ও হলুদের জমিতে নতুন করে নিড়ানি না দিয়েই বাড়তি কিছু সার প্রয়োগের মাধ্যমে নূ্যনতম খরচে তুলাচাষ করে কৃষকরা ব্যাপকভাবে লাভবান হচ্ছে। প্রতিবিঘা জমিতে আট থেকে নয় মণ স্থানীয় জাতের তুলার ফলন হলেও একই জমিতে ১৪ থেকে ১৫ মণ হাইব্রিডজাতের তুলার ফলন হচ্ছে। এছাড়া স্থানীয় জাতের তুলনায় হাইব্রিডজাতের তুলার বাজারমূল্যও প্রায় বেশ কয়েক গুণ বেশি। পোকার আক্রমণ নেই বললেই চলে। সব মিলিয়ে পুরাতন তুলা চাষিরা আর কেউই স্থানীয় জাতের তুলা চাষে মোটেই আগ্রহী নয়। তারা ক্রমেই ঝুঁকে পড়ছে হাইব্রিডজাতের তুলা চাষে।
বস্ত্র শিল্পের প্রধান কাঁচামাল যোগানদানকারী ফসল তুলার বীজ হতে তেল ও খৈল, অপরিশোধিত তেল থেকে সাবান তৈরি এবং পরিশোধিত তেল ভোজ্য তেল হিসেবে ব্যবহারসহ তুলার বহুবিধ ব্যবহার চাষিদের মধ্যে তুলাচাষে ব্যাপক উৎসাহের সৃষ্টি করেছে।
কুষ্টিয়া জোনের প্রধান তুলা উন্নয়ন কর্মকর্তা সুভাষ চন্দ্র দেবনাথ জানান, স্থানীয় জাতের তুলায় পোকামাকড়ের আক্রমণ বেশি। কিন্তু হাইব্রিডজাতের তুলার আবাদ করলে স্পটেড বোল-ওয়ার্ম পোকার আক্রমণ হয় না। ফলে কীটনাশক খরচ কম হয় এবং তুলার ফলন প্রায় দ্বিগুণেরও বেশি হওয়ায় চাষিরা হাইব্রিড জাতের তুলা চাষে আগ্রহ ও উৎসাহ দেখাচ্ছে।
এ এলাকায় হলুদ ও মরিচের সাথে সাথী ফসল হিসেবে তুলাচাষ করে চাষিরা ব্যাপকভাবে লাভবান হওয়ায় আগামীতে এখানে চাষাবাদ আরো বাড়বে। একই ধরনের আশাবাদ কৃষকদেরও। তবে তাদের দাবি হাইব্রিড বীজের মূল্য হ্রাস করার পাশাপাশি তুলার বাজারমূল্য দুই হাজার থেকে আড়াই হাজার টাকায় উন্নীত করা হলে এ অঞ্চলে তুলাচাষ ব্যাপক মাত্রায় ছড়িয়ে পড়বে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন