শনিবার, ৬ মার্চ, ২০১০

গরু গবেষণা : উদ্যোগ

ঘাটতি মেটাবে রেড চিটাগং
বাংলাদেশের গরুর নিজস্ব কোনো জাত (ব্রিড) না থাকলেও দুটি উপজাত (প্রজাতি) রয়েছে। এগুলো হলো রেড চিটাগং এবং পাবনা মিল্কিং কাউ। এ দুটি উপজাতের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ দুধ উৎপাদন (এক থেকে সাত কেজি), রোগ প্রতিরোধ, বাচ্চা উৎপাদন ও লালন-পালনে সুবিধার দিক দিয়ে রেড চিটাগং এগিয়ে। এসব কারণেই দেশের দুধ উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে রেড চিটাগাং উপজাতের গরুকে জাত হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতির লক্ষ্যে কাজ করে চলেছেন বাংলাদেশসহ আমেরিকার বেশ কিছু বিজ্ঞানী এবং গবেষকরা। ইউনাইটেড স্টেটস ডিপার্টমেন্ট অব অ্যাগ্রিকালচারের (ইউএসডিএ) অর্থায়নে 'কনজারভেশন অ্যান্ড ক্যারেক্টারাইজেশন অব রেড চিটাগং ক্যাটল' প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে। দেশিকে দেশি রেখে কৃষকের চাহিদা ও ব্যবহারোপযোগী করতে রেড চিটাগং উপজাতটিকে ক্রমাগতভাবে অধিক উৎপাদনশীল (লক্ষ্যমাত্রা গড়ে চার কেজি) জাতে উন্নীত করাই এ প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য। এ প্রকল্পে কাজ করছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) পশু প্রজনন এবং কৌলিতত্ত্ব, পশু পুষ্টি, ডেইরি বিজ্ঞান এবং মেডিসিন বিভাগের একদল গবেষক।
প্রকল্পের প্রধান গবেষক এবং পরিচালক অধ্যাপক ড. এ কে ফজলুল হক ভুঁইয়া কালের কণ্ঠকে জানান, রেড চিটাগং উপজাতের গরুর মূল উৎপত্তিস্থল বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাংশের বৃহত্তর চট্টগ্রাম জেলায়। জেলার সর্বত্র কমবেশি এ গরু পাওয়া গেলেও রাউজান, আনোয়ারা, পটিয়া, চন্দনাইশ এবং বাঁশখালী উপজেলায় এর বিস্তৃতি বেশি। তবে কুমিল্লা ও নোয়াখালীর কিছু জায়গাসহ সারা দেশে খুব অল্প পরিসরে এদের সন্ধান পাওয়া গেছে। প্রকল্পের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে ড. ভুঁইয়া বলেন, চট্টগ্রামের বেশ কিছু স্থান থেকে বাছাই করা উন্নত বৈশিষ্ট্যধর্মী রেড চিটাগং গাভি সংগ্রহ করে বাকৃবির ডেইরি ফার্ম এবং কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্রে (এআই সেন্টার) সংরক্ষণ করা হয়। পাশাপাশি একই প্রক্রিয়ায় উন্নত বৈশিষ্ট্যধর্মী ষাঁড়ও সংগ্রহ করা হয়। পরে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে আরো উন্নত বৈশিষ্ট্যধর্মী বাচ্চা উৎপাদন করা হয়।
ড. ভুঁইয়া বলেন, রেড চিটাগং বাংলাদেশের নিজস্ব উপজাতের গরু। এদের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে_প্রতিবছর একটি করে বাচ্চা দেয় এবং এদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা খুবই বেশি। ফলে সহজে এরা রোগাক্রান্ত হয় না। এরা প্রতিদিন গড়ে তিন-চার লিটার দুধ দেয়। এদের খাদ্য চাহিদা মেটানোর জন্য আলাদা কোনো জোগাড়ের প্রয়োজন হয় না বিধায় লালন-পালনে খরচও খুব কম হয়, যা পৃথিবীর হাজারো গরুর মধ্যে আজও পরিলক্ষিত হয়নি। ফলে দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য এ গরু খুবই উপযুক্ত। এ প্রকল্প থেকে উৎকৃষ্ট প্রজনন ষাঁড় নিয়ে ব্র্যাক, প্র্যাকটিক্যাল অ্যাকশন বাংলাদেশ, ড্যানিডা, এলজিইডি এবং গাভি বা বকনা নিয়ে অনেক কৃষক ইতিমধ্যে সুফল পেয়েছেন। মাঠপর্যায়ে সম্প্রসারণের লক্ষ্যে চট্টগ্রাম ছাড়া দেশের অন্যান্য জেলার সমতলভূমি ও কৃষকের বাড়িতে এ জাত কতটা উপযোগী, তা যাচাইয়ের জন্য গত বছরের জানুয়ারি থেকে ওয়ার্ল্ডভিশন বাংলাদেশ-এর যৌথ উদ্যোগে ময়মনসিংহের চরাঞ্চলে ৭০ খামারিকে সমিতিভুক্ত করে উদ্ভাবিত ১০০ রেড চিটাগং বীজ গরু প্রদান করা হয়েছে। এ ছাড়া চুক্তিবদ্ধ উপায়ে দেশের বিভিন্ন জেলার কৃষকদের কাছে এ উন্নত জাতের গাভি সরবরাহ করা হবে বলে ড. ভুঁইয়া জানান।
বিশেষ প্রকল্প 'সিডিভিএস'
চিকিৎসাসেবার মাধ্যমে গাভির সঠিক পরিচর্যা করেও যে দুধের উৎপাদন বাড়ানো যায়, সেটাই প্রমাণ করতে সফল হয়েছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) ভেটেরিনারি অনুষদের একদল গবেষক। খামারভিত্তিক চিকিৎসাসেবা প্রদানের মাধ্যমে দেশে দুধের অপর্যাপ্ততা দূরীকরণ এবং দুগ্ধশিল্পের উন্নয়নের লক্ষ্যে ২০০১ সাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জারি অ্যান্ড অবস্টেট্রিকস বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শামছুদ্দিন 'কমিউনিটি বেজ্ড ডেইরি ভেটেরিনারি সার্ভিস (সিডিভিএস)' শীর্ষক একটি প্রকল্পের কাজ শুরু করেন। ইউনাইটেড স্টেটস ডিপার্টমেন্ট অব অ্যাগ্রিকালচারের (ইউএসডিএ) দুই কোটি ৩১ লাখ টাকার আর্থিক সহায়তায় ২০০১ সালে সর্বপ্রথম 'ফিল্ড ফার্টিলিটি ক্লিনিক' নামে একটি প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। পরে প্রকল্পটির সফল বাস্তবায়নের ফলে ২০০৬ সালে পুনরায় একই সংস্থা বাংলাদেশে দুগ্ধবতী গাভি উৎপাদন এবং সঠিক বাজারব্যবস্থার উন্নয়নের লক্ষ্যে অতিরিক্ত মেয়াদে প্রকল্পটি ২০১১ সাল পর্যন্ত সম্প্রসারিত করে। এতে এক কোটি ৮৬ লাখ টাকার বাজেট অনুমোদন হয়। ওই প্রকল্পের অংশ হিসেবে 'সিডিভিএস' প্রতিষ্ঠা হয়।
প্রকল্পের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে ড. শামছুদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, এ প্রকল্পের আওতায় সাতক্ষীরা, সিরাজগঞ্জ, জয়পুরহাট, চট্টগ্রাম এবং ময়মনসিংহ জেলায় মোট ১০ ভেটেরিনারিয়ান (পশু চিকিৎসক), ছয়জন মাঠ পরিদর্শক এবং ৮০ দুগ্ধ সংগ্রহকারী প্রকল্পের আওতায় কাজ করছেন। একজন ভেটেরিনারিয়ান প্রতি মাসে প্রায় ২৫০টি খামার পরিদর্শন করেন। এ ছাড়া তাঁরা যেকোনো মুহূর্তে অসুস্থ গরুর চিকিৎসাসহ বছরে দুবার গরুর প্রয়োজনীয় কৃমির টিকা এবং খুরারোগের ভ্যাকসিন বিনা মূল্যে সরবরাহ করে থাকেন।
ড. শামছুদ্দিন আরো বলেন, প্রকল্পের অধীনে সাতক্ষীরা জেলার চাঁদপুর, আলীকোরক, ভাড়াশিমলা, কুশলিয়া এবং তালা ইউনিয়নে একটি করে দুধ সংগ্রহ কেন্দ্র রয়েছে। এসব অঞ্চল থেকে প্রতিদিন প্রায় নয় হাজার লিটার দুধ প্রকল্প কর্তৃক নির্ধারিত সংগ্রাহকের মাধ্যমে সংগ্রহ করা হয়। সংগৃহীত দুধ ওই সংগ্রহকারীর মাধ্যমে একটি সাবস্টেশনে সংগ্রহ করা হয় এবং পরে তা পূর্ব চুক্তি মোতাবেক আড়ং দুধ কোম্পানির কাছে বিক্রি করা হয়, যার বিনিময়ে কম্পানিটি প্রতি লিটার দুধের জন্য ১.৬৫ টাকা হারে সিডিভিএসকে পরিশোধ করে। অনুরূপভাবে সিরাজগঞ্জ ও জয়পুরহাট জেলার কয়েকটি স্থান থেকেও একই প্রক্রিয়ায় প্রকল্পের অধীনে প্রতিদিন প্রায় এক হাজার লিটার দুধ সংগ্রহ করে আড়ং দুধ কম্পানির কাছে বিক্রি করা হয়। আড়ং সংগ্রহ করা মোট দুধের প্রায় ১০ শতাংশ এ প্রকল্পের বিভিন্ন সাবস্টেশন থেকে সরবরাহ করা হয়। এ দুধে ফ্যাটের পরিমাণ বেশি (গড়ে ৪ শতাংশ) থাকে বিধায় আড়ং এ দুধ কিনতে বেশি আগ্রহী। এভাবে প্রতিবছর প্রকল্পটি আড়ং কোম্পানির কাছ থেকে প্রায় ৬০ লাখ টাকা উপার্জন করে। উপার্জনকৃত এ টাকা দিয়ে প্রকল্পের আওতাভুক্ত খামারিদের বিনা মূল্যে বছরে দুবার কৃমিনাশক ও খুরারোগের প্রতিষেধক প্রদান করা হয়। এ ছাড়া সম্পূর্ণ বিনা মূল্যে গাভির অন্যান্য চিকিৎসাসেবার পাশাপাশি প্রকল্পের অধীনে কর্মরত ডাক্তার, মাঠ পরিদর্শক এবং দুধ সংগ্রহাক, বাড়িভাড়াসহ অন্যান্য খরচ বহন করা হয়। যার ফলে দুধ উৎপাদন খরচও বহুলাংশে হ্রাস পায় এবং খামারিরা অধিক মুনাফা অর্জন করতে পারে। এ ছাড়া প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হলেও যাতে এসব কার্যক্রম বন্ধ না হয়ে যায় সে উদ্দেশ্যে কিছু অর্থ প্রকল্পের নির্দিষ্ট ব্যাংক হিসাবে জমা করা হয়।
সাতক্ষীরা, সিরাজগঞ্জ ও জয়পুরহাট জেলার পাশাপাশি চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহ জেলার নির্দিষ্ট ইউনিয়নে প্রকল্পের অধীনে সম্পূর্ণ বিনা মূল্যে পশু চিকিৎসাসেবা প্রদান করা হয়ে থাকে।
ড. শামছুদ্দিন বলেন, গাভির সঠিক পরিচর্যা ও চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করার মাধ্যমে এসব অঞ্চলের গাভিপ্রতি প্রতিদিন গড় দুধ উৎপাদন প্রায় এক লিটার বৃদ্ধি করা সম্ভব হয়েছে। এভাবে পরিকল্পিত পদ্ধতিতে গাভি পালনের মাধ্যমে দেশের দুধের ঘাটতি অনেকাংশে মেটানো যাবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হিসেবে দুধ উৎপাদন আরো বৃদ্ধি করা, ২০১২ সাল নাগাদ দেশের বিভিন্ন স্থানে কমপক্ষে ৫০টি কমিউনিটি সেন্টার স্থাপন করা, গোখাদ্য এবং কৃত্রিম প্রজনন ব্যবস্থাকে আরো মাঠপর্যায়ে সম্প্রসারণ করার প্রক্রিয়া চলছে। ইতিমধ্যেই বেসরকারি সংস্থা 'কেয়ার' ময়মনসিংহ ও জামালপুরে এ প্রকল্প সম্প্রসারণে প্রায় ২১ লাখ টাকার একটি সমঝোতা চুক্তি করেছে। তবে তিনি জোর দিয়ে বলেন, এ প্রযুক্তি মাঠপর্যায়ে সম্প্রসারণের জন্য আরো সরকারি ও বেসরকারি সহযোগিতা একান্ত কাম্য।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন