বৃহস্পতিবার, ১৮ মার্চ, ২০১০

হাইড্রোপনিক পদ্ধতি মাটিবিহীন চাষাবাদ

গাছ আছে, ফল আছে, ফুল আছে আপনার প্রিয় আঙিনায়; কিন্তু গাছের নীচে মাটি নেই। ভাবছেন এটা আবার হয় নাকি! হয়। আপনার আঙিনায় মাটি ছাড়াই জন্মাবে প্রিয় ফসল, ফুল, সবজি। মাটির পরিবর্তে পানিতেই জন্মাতে পারবেন টমেটো, লেটুস, ফুলকপি, বাঁধাকপি, শসা, ক্ষিরা, ক্যাপসিকাম, স্ট্রবেরি, এ্যানথরিয়াম, গাঁদা, গোলাপ, অর্কিড, চন্দ্রমলিস্নকা আরো অনেক ফসল। মাটিবিহীন পানিতে ফসল উৎপাদনের এই কৌশলকে বলে হাইড্রোপনিক যা একটি অত্যাধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে সারাবছরই সবজি ও ফল উৎপাদন করা সম্ভব। এই চাষাবাদে কোনো কীটনাশক বা আগাছানাশক কিংবা অতিরিক্ত সার দেয়ার প্রয়োজন হবে না। তাই অনায়াসে গড়ে তুলতে পারবেন অর্গানিক ফসলের সম্ভার। সমপ্রতি বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) -এর বিজ্ঞানীরা এই প্রযুক্তিতে চাষাবাদ শুরম্ন করেছেন।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের ঊধর্্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এ.কে. এম. সেলিক রেজা মলিস্নক ১৯৯৭ সালে জাপানে হাইড্রোপনিক প্রযুক্তির উপর প্রশিক্ষণ নিয়ে এই প্রযুক্তি প্রথম বাংলাদেশে নিয়ে আসেন ২০০৬ সালে। ২০০৭ সালে তিনি বাংলাদেশের জলবায়ুর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হাইড্রোপনিক প্রযুক্তির গবেষণা শুরম্ন করেন টমেটো, ক্যাপসিকাম, লেটুস ও স্ট্রবেরি এই ৪টি ফসল নিয়ে। এ গবেষণায় সাফল্যের পর ২০০৮ সালে এর সাথে ক্ষিরা, শসা, গাঁদা ফুল ও বেগুন এবং ২০০৯ সালে বামন সিম, ফুলকপি, বাঁধাকপি, ব্রকোলি, চন্দ্রমলিস্নকা যোগ করেন। বিজ্ঞানী মলিস্নক এ গবেষণায় ব্যাপকভাবে সাফল্য পান।
তিনি জানান, লাভজনক ফসলের ক্ষেত্রে এ হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে মাটির পরিবর্তে পানিতে গাছের প্রয়োজনীয় খাবার সরবরাহ করে ফসল উৎপাদন করা হয়। জনবহুল দেশে যেখানে স্বাভাবিক চাষের জমি কম কিংবা নেই সেখানে ঘরের ছাদে বা আঙিনায়, পলি টানেল, নেট হাউজে হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে সবজি ও ফল উৎপাদন সম্ভব। উন্নত বিশ্বের যেমন : ইউরোপ, আমেরিকা, জাপান, তাইওয়ান, চীন, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহে বাণিজ্যিকভাবে হাইড্রোপনিক পদ্ধতির মাধ্যমে সবজি ও ফল উৎপাদন করা হচ্ছে। এই পদ্ধতিতে সারাবছরই সবজি ও ফল উৎপাদন করা সম্ভব এবং উৎপাদিত সবজি ও ফলে কোনো কীটনাশক ব্যবহার করা লাগে না বিধায় এ সবজি ও ফল নিরাপদ এবং অধিক বাজারমূল্য পাওয়া যায়।
সাধারণত দু'ভাবে হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করা যায়। সঞ্চালন পদ্ধতি এবং সঞ্চালনবিহীন পদ্ধতি।
সঞ্চালন পদ্ধতিতে গাছের অত্যাবশকীয় খাদ্য উপাদানসমূহ যথাযথ মাত্রায় মিশ্রিত করে একটি ট্যাংকিতে নেয়া হয় এবং পাম্পের সাহায্যে পাইপের মাধ্যমে ট্রেতে পুষ্টি দ্রবণ সঞ্চালন করে ফসল উৎপাদন করা হয়। প্রতিদিন অনত্মতপক্ষে ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা পাম্পের সাহায্যে এই সঞ্চালন প্রক্রিয়া চালু রাখা দরকার। এই পদ্ধতিতে প্রাথমিকভাবে প্রথম বছর ট্রে, পামপ এবং পাইপের আনুসাঙ্গিক খরচ একটু বেশি হলেও পরবর্তী বছর থেকে শুধুমাত্র রাসায়নিক খাদ্য উপাদানের খরচ প্রয়োজন হয়। ফলে দ্বিতীয় বছর থেকে খরচ অনেকাংশে কমে যায়। এ পদ্ধতিতে গ্যালভানাইজিং লোহার ট্রের উপর কর্কশিটের মাঝে গাছের প্রয়োজনীয় দূরত্ব অনুসারে যেমন_ লেটুস ২০ দ্ধ ২০ সে. মি. টমেটো ৫০ দ্ধ ৪০ সে. মি. এবং স্ট্রবেরি ৩০ দ্ধ ৩০ সে. মি. দূরত্বে গর্ত করতে হয়। উপযুক্ত বয়সের চারা স্পঞ্জসহ ওই গর্তে স্থাপন করতে হয়। অপরদিকে, সঞ্চালনবিহীন পদ্ধতিতে একটি ট্রেতে গাছের প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদানসমূহ পরিমিত মাত্রায় সরবরাহ করে সরাসরি ফসল চাষ করা হয়।
এই পদ্ধতিতে খাদ্য উপাদান সরবরাহের জন্য কোনো পাম্প বা পানি সঞ্চালনের প্রয়োজন হয় না। এক্ষেত্রে খাদ্য উপাদান মিশ্রিত দ্রবণ ও তার উপর স্থাপিত কর্কশিটের মাঝে ২ থেকে ৩ ইঞ্চি পরিমাণ জায়গা ফাঁকা রাখতে হবে। কর্কশিটের উপরে ৪ থেকে ৫টি ছোট ছোট ছিদ্র করে দিতে হবে যাতে বাতাস চলাচল করতে পারে এবং গাছ তার প্রয়োজনীয় অক্সিজেন কর্কশিটের ফাঁকা জায়গা থেকে সংগ্রহ করতে পারে। ফসলের প্রকার ভেদে সাধারণত ২ থেকে ৩ বার এই খাদ্য উপাদান ট্রেতে যোগ করতে হয়। আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ সহজেই এই পদ্ধতি অনুসরণ করে পস্নাস্টিক বালতি, পানির বোতল, মাটির পাতিল, ইত্যাদি ব্যবহার করে বাড়ির ছাদ, বারান্দা এবং খোলা জায়গায় সঞ্চালনবিহীন পদ্ধতিতে সবজি উৎপাদন করতে পারে। এতে খরচ তুলনামূলকভাবে অনেক কম হবে।
যে সকল ফসল হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করা যাবে তা হল_ পাতা জাতীয় সবজির মধ্যে লেটুস, গীমাকলমি, বিলাতি ধনিয়া, বাঁধাকপি। ফল জাতীয় সবজির মধ্যে টমেটো, বেগুন, ক্যাপসিকাম, ফুলকপি, শসা, ক্ষিরা, মেলন, স্কোয়াস, ফল স্ট্রবেরি, ফুল এ্যানথরিয়াম, গাঁদা, গোলাপ, অর্কিড, চন্দ্রমলিস্নকা, জারবেরা ইত্যাদি। হাইড্রোপনিক পদ্ধতির চারা উৎপাদন প্রসঙ্গে বিজ্ঞানী মলিস্নক বলেন, হাইড্রোপনিকস পদ্ধতিতে চারা উৎপাদনের জন্য স্পঞ্জ বস্নক ব্যবহার করা হয়। সাধারণত স্পঞ্জকে ৩০ সে. দ্ধ ৩০ সে. সাইজে কেটে নিতে হয়। এই স্পঞ্জকে ২.৫ সে মি. দৈঘর্্য এবং ২.৫ সে. মি. প্রস্থ বর্গাকারে, ডট ডট করে কেটে নিতে হয় এবং এর মাঝে এক সে. মি. করে কেটে প্রতিটি বর্গাকারে স্পঞ্জের মধ্যে একটি করে বীজ বপন করতে হয়। বীজ বপনের পূর্বে বীজকে ১০% ক্যালসিয়াম অথবা সোডিয়াম হাইপোক্লোরাইড দিয়ে বীজ শোধন করে নিতে হবে। বীজ বপনের পর স্পঞ্জকে একটি ছোট ট্রেতে রাখতে হবে। এই ট্রের মধ্যে ৫ থেকে ৮ সে. মি. পানি রাখতে হবে যাতে স্পঞ্জটি পানিতে সহজে ভাসতে পারে। চারা গজানোর ২ থেকে ৩ দিন পর প্রাথমিক অবস্থায় ৫ থেকে ১০ মি. লি. খাদ্য উপাদানে সম্বলিত দ্রবণ এক বার এবং চারা গজানোর ১০ থেকে ১২ দিন পর থেকে চারা রোপণের পূর্ব পর্যনত্ম প্রতিদিন ১০ থেকে ২০ মি. লি. দ্রবণ দিতে হবে। এ পদ্ধতিতে চারা রোপণের পর দ্রবণের পিএইচ মাত্রা ৫.৮ থেকে ৬.৫ -এর মধ্যে এবং ইসি মাত্রা ১.৫ থেকে ১.৯ -এর মধ্যে রাখা দরকার। গাছের বৃদ্ধির পর্যায়ে ওপর থেকে সুতা বা শক্ত রশি ঝুলিয়ে গাছ সোজা ও দাঁড় করিয়ে রাখতে হয় এবং পরিচর্যা সাধারণ গাছের মতই করতে হবে।
হাইড্রোপনিক পদ্ধতির জন্য রাসায়নিক দ্রব্যের পরিমাণ ও তৈরির প্রক্রিয়া একটু ভিন্ন রকম। প্রতি এক হাজার লিটার পানির জন্য পটাশিয়াম হাইড্রোজেন ফসফেট ২৭০ গ্রাম, পটাসিয়াম নাইট্রেট ৫৮০ গ্রাম, ক্যালসিয়াম নাইট্রেট এক হাজার গ্রাম, ম্যাগানেসিয়াম সালফেট ৫১০ গ্রাম, ইডিটিএ আয়রন ৮০ গ্রাম, ম্যাঙ্গানিজ সালফেট ৬.১০ গ্রাম, বরিক এসিড ১.৮০ গ্রাম, কপার সালফেট ০.৪০ গ্রাম, অ্যামনিয়াম মলিবটেড ০.৩৮ গ্রাম, জিংক সালফেট ০.৪৪ গ্রাম হারে পানিতে মিশিয়ে খাদ্য দ্রবণ তৈরি করতে হবে।
জলীয় খাদ্য দ্রবণ তৈরির সময় বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। প্রথমে ঝঃড়পশ ঝড়ষঁঃরড়হ তৈরি করতে হবে। এই ঝঃড়পশ তৈরি করার সময় ক্যালসিয়াম নাইট্রেট এবং ঊউঞঅ ওৎড়হ কে পরিমাপ করে ১০ লিটার পানিতে দ্রবীভূত করে দ্রবণকে ঝঃড়পশ ঝড়ষঁঃরড়হ "অ" নামে নামকরণ করতে হবে। অবশিষ্ট রাসায়নিক দ্রব্যগুলোকে একসাথে ১০ লিটার পাানিতে দ্রবীভূত করে ঝঃড়পশ ঝড়ষঁঃরড়হ "ইচ্ নামে নামকরণ করতে হবে। এক হাজার লিটার জলীয় দ্রবণ তৈরির ক্ষেত্রে প্রথমে এক হাজার লিটার পানি ট্যাংকে নিতে হবে। তারপর ঝঃড়পশ ঝড়ষঁঃরড়হ অ থেকে ১০ লিটার দ্রবণ ট্যাংকের পানিতে ঢালতে হবে এবং একটি অ-ধাতব দ-ের সাহায্যে নাড়াচাড়া করে ভালভাবে মেশাতে হবে। এরপর ঝঃড়পশ ঝড়ষঁঃরড়হ "ই" থেকে আগের মত ১০ লিটার দ্রবণ ট্যাংকে নিতে হবে এবং আগের মতই অ-ধাতব দ-ের সাহয্যে পানিতে ঝঃড়পশ ঝড়ষঁঃরড়হ গুলি সমানভাবে মেশাতে হবে।
হাইড্রোপনিক পদ্ধতির চাষাবাদের সুবিধা নিয়ে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক ড. মো. আব্দুল হক জানান, এ পদ্ধতিতে আবাদি জমির প্রয়োজন হয় না বিধায় সারাবছর কিংবা অমৌসুমেও সবজি, ফল, ফুল চাষাবাদ করা যায়। পদ্ধতিটি মাটিবিহীন চাষ পদ্ধতি হওয়ায় মাটিবাহিত রোগ ও কৃমিজনিত রোগ হয় না। কীটপতঙ্গের আক্রমণ কম হওয়ার কারণে এই পদ্ধতিতে কীটনাশকমুক্ত সবজি উৎপাদন করা সম্ভব। এই পদ্ধতিতে ছোট এবং বড় পরিসরে স্বাস্থ্যসন্মত এবং পরিচ্ছন্নভাবে ফসল উৎপাদন করা যায়। এটি হোম-ফার্মিং এর জন্য একটি আদর্শ প্রযুক্তি বিধায় অধিক লাভজনক, অর্থকরী ও মানসম্পন্ন ফসল উৎপাদন করা সম্ভব।
বিভিন্ন কারণে দেশে মাথাপিছু চাষযোগ্য জমির পরিমাণ সংকুচিত হচ্ছে। বর্ধিত জনসংখ্যার অব্যাহত খাদ্য চাহিদা পূরণের লৰ্যে শুধু আবাদি জমির উপর নির্ভর করা যাবে না। দেশের এমনি অবস্থায় প্রয়োজন অব্যবহৃত খালি জায়গা ও পতিত জায়গা শস্য চাষের আওতায় আনা। হাইড্রোপনিকস চাষ পদ্ধতি এ ৰেত্রে সঠিকভাবে আরোপযোগ্য একটি কৌশল। এ পদ্ধতি বাড়ির ছাদে, আঙিনায়, বারান্দায় কিংবা চাষের অযোগ্য পতিত জমিতে সহজেই চাষাবাদের আওতায় আনা সম্ভব। এতে করে একদিকে যেমন পতিত জমি বা অব্যবহৃত জায়গার সফল ব্যবহার হবে, অন্যদিকে দেশ অর্থনৈতিকভাবে অনেক লাভবান হবে।
লেখক : কৃষিবিদ, বৈজ্ঞানিক কর্মকতর্াফল গবেষণা কেন্দ্র, বিনোদপুর, রাজশাহী

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন