শনিবার, ২০ মার্চ, ২০১০

হিটস্ট্রোক এড়ানোর উপায়

প্রচণ্ড গরম পড়েছে সারা দেশে। প্রায় সব খামারেই হিটস্ট্রোকে মারা যাচ্ছে মোরগ-মুরগি। গরমের সময় মোরগ-মুরগি চারপাশের তাপের কারণে তার দেহ থেকে তাপ বের করতে পারে না বলে শ্বাসকষ্ট হয় এবং হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়। একসময় এই মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে যায় বলে মোরগ-মুরগি হিটস্ট্রোকে মারা যায়।
লক্ষ রাখতে হবে ফিড : এ সময় মুরগির ফিড গ্রহণের পরিমাণ কমে যায়। সেই কারণে দিনের নির্দিষ্ট বেশি গরমের সময় ব্রিডার লেয়ারের ক্ষেত্রে ফিড না দেওয়াই ভালো। শুধু পানি খাবে। দিনের ঠাণ্ডা সময় যেমন ভোর ও সন্ধ্যার পর ফিড দিতে হবে।
এ সময় খামারে দেওয়া ফিডে বিশেষ লক্ষ রাখতে হবে, ফিডে যেন পুষ্টিমান সঠিক এবং বেশি থাকে। যেমন_স্বাভাবিক ১০০ গ্রাম ফিডের পুষ্টি ৯০ গ্রাম ফিডে থাকতে হবে। সে কারণে ফিডে ব্যবহার করা প্রোটিনের ক্ষেত্রে অতি উচ্চমানের প্রোটিন ব্যবহার করতে হবে। লক্ষ রাখতে হবে, এই প্রোটিনে প্রয়োজনীয় অ্যামাইনো এসিড মিথুনিন, লাইসিন ঘাটতি আছে কি না? যদি ঘাটতি থাকে তাহলে বাড়তি অ্যামাইনো এসিড মেশাতে হবে।
খামারে রেডি ফিড (পিলেট ফিড) ব্যবহারের ক্ষেত্রে ফিডে অ্যামাইনো এসিড মেশানোর উপায় থাকে না। সে ক্ষেত্রে পানির মাধ্যমে তরল মিথুনিন যেমন রেডিমেড এটি-৮৮ পানিতে খাওয়াতে হবে। প্রতি লিটার পানিতে এক থেকে দুই মিলিলিটার দিতে হবে। এ ছাড়া অন্যান্য অ্যামাইনো এসিডের ঘাটতি পূরণের জন্য অ্যামাইনো লাইটস এবং অ্যামাইনো এসিড ও শক্তি সরবরাহের জন্য অ্যামাইনো-১৮ পানির সঙ্গে খাওয়াতে হবে।
হিটস্ট্রোক প্রতিরোধ : গরমের সময় রক্ত চলাচল দ্রুততর হওয়ার জন্য হৃৎস্পন্দন বেড়ে যায় ও কোনো কোনো সময় রক্ত জমাট হতে পারে। এই রক্ত জমাট হওয়াটাই হিটস্ট্রোক। এতে মুরগি মারা যেতে পারে। এ সময় এসপিরিন ও ভিটামিন-সিযুক্ত কোনো মিশ্রণ যেমন এন্টি স্ট্রেস প্রিমিক্স দিনের উষ্ণতম সময় যেমন সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত পানির মাধ্যমে খাওয়ালে হিটস্ট্রোকের পরিমাণ অনেক কমে যায়। এ ছাড়া ফিডেও ভিটামিন-সিযুক্ত প্রিমিক্স ব্যবহার করা যেতে পারে।
গরমের বাড়তি যত্ন : গরমে পোলট্রি খামারে বিশেষ যত্ন না নিলে ফ্লকে বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। এখনকার তাপজনিত ধকলে মুরগির দৈহিক ওজন কমে যাওয়াসহ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। ডিম উৎপাদন কমে যায় এবং মোরগ-মুরগির মৃত্যুও হতে পারে। এ সময় বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে।
খামারে এক দিনের বাচ্চা আসার আগে পরিষ্কার ও ঠাণ্ডা পানির ব্যবস্থা করতে হবে। প্রয়োজনে পানির সঙ্গে ভিটামিন সি, আখের গুড় অথবা ইলেকট্রোলাইটযুক্ত স্যালাইন পানির সঙ্গে দিতে হবে।
খামার শেডে বাতাসের অবাধ চলাচলের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। মুক্ত বাতাস শেড অভ্যন্তরের তাপমাত্রা শীতল রাখবে, সেই সঙ্গে অ্যামোনিয়াসহ অন্যান্য ক্ষতিকর গ্যাসের বিষক্রিয়াও মুক্ত রাখবে। শেডে সিলিং ফ্যানের পাশাপাশি এগজস্ট ফ্যানের ব্যবস্থা করতে হবে।
শেডে মোরগ-মুরগি যেন আরামদায়ক পরিবেশে বাস করতে পারে সেদিকে নজর দিতে হবে। অহেতুক এদের বিরক্ত করা যাবে না। প্রতিটি বড় মুরগিকে এক বর্গফুটের অধিক জায়গা দিতে হবে।
অধিক রোদে টিনের চালা অতিরিক্ত গরম হলে দিনে দুই-একবার চালায় পানি ছিটানোর ব্যবস্থা করতে হবে। টিনের চালার নিচে চাটাই, হার্ডবোর্ড দিয়ে শিলিংয়ের (চাতাল) ব্যবস্থা করতে হবে।
শেডের চারপাশে সপ্তাহে দুবার চুন ছিটানোর ব্যবস্থা করতে হবে। ব্রয়লার লিটার ভোর কিংবা রাতে ওলটপালট করে দিতে হবে।
খাবার পাত্র ও পানির পাত্রসংখ্যা বাড়িয়ে দিতে হবে। পানির পাত্রে দিনে কমপক্ষে তিনবার পরিষ্কার ঠাণ্ডা পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।
গরমের ধকলের কারণে মাইকোপ্লাজমা ও কলিব্যাসিলোসিস রোগের আক্রমণ বেড়ে যায়। সে কারণে এ সময় মুরগির স্বাস্থ্যবিধি পুরোপুরি মেনে চলা প্রয়োজন। বিশেষ করে ফিড ও পানিতে ভিটামিন-সি ও ভিটামিন-ই ব্যবহার করতে হবে।
গরমকালে বাতাসের আর্দ্রতা বেড়ে যাওয়ায় শেডের মেঝেয় অনেক সময় লিটার দ্রুত ভিজে যায়। যার ফলে রোগ আক্রমণও বেশি হয়। সে কারণে লিটারে পাউডার চুন ব্যবহার করতে হবে। এ সময় ফিডের বস্তা খোলা রাখা যাবে না। কারণ বাতাসের আর্দ্রতা বেড়ে ফিডে ছত্রাক বা মোল্ড জন্মায়, যা পোলট্রি খাদ্যের উপযুক্ত নয়।

বৃহস্পতিবার, ১৮ মার্চ, ২০১০

থাই কৈ : প্রজনন ও চাষ_৪

ভাল ব্যবস্থাপনা নিলে ছোট বড় সব ধরনের পুকুরে কৈ মাছের চাষ করা যায়। পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, বর্গাকার পুকুরের চেয়ে আয়তাকার পুকুরে কৈ চাষের ফলন বেশি হয়। ২ ধাপে এই মাছের চাষ করা যায়।
একটি পুকুর ব্যবহার করে বা সরাসরি এবং দু'টি পুকুর ব্যবহার করে বা নার্সিং করে।
একটি পুকুর ব্যবহার পদ্ধতি : একটি পুকুর ব্যবহার করে বা সরাসরি প্রায় এক ইঞ্চি সাইজের কৈ মাছের পোনা ছাড়লে ওই পুকুরের ২য় পদ্ধতির চেয়ে কমপক্ষে ১০ দিন আগে বাজারজাত করা যায়। এ ক্ষেত্রে পোনার মজুদ থেকে ২০% পোনা বাদ দিয়ে পোনা মজুদ ধরতে হবে। যেমন সরাসরি একটি পুকুরে ৫০ হাজার পোনা ছাড়ার পর ওই পুকুরের মজুদ ধরতে হবে ৪০ হাজার।
২য় পুকুর ব্যবহার পদ্ধতি : ২য় পুকুর ব্যবহার করেও এই মাছের চাষ করা যায়। সে ক্ষেত্রে প্রথমে একটি ছোট পুকুরে প্রায় এক ইঞ্চি সাইজের কৈ মাছের পোনা ছেড়ে নার্সিং করতে হবে প্রায় ২০ দিন। এক্ষেত্রে প্রতি শতাংশে প্রায় ২ হাজার পোনা মজুদ করা যাবে। প্রায় ২০ দিন নার্সিং করার পর ২য় পুকুরে স্থনানত্মর করতে হবে। কৈ মাছের পোনা স্থানানত্মর করার সময় কিছু বিশেষ দিকে খেয়াল রাখতে হবে। যেমন মেঘলা আকাশে কৈ মাছের পোনা স্থনানত্মর করা উচিৎ হবে না। রৌদ্রজ্জ্বল আকাশে বেলা ১১ টার দিকে কৈ মাছের পোনা স্থানানত্মর করতে হবে। আবার বেলা ১২ টার পর স্থনানত্মর করা ঠিক হবে না। ১১টার আগে পোনা স্থানানত্মর করলে কিছু বোঝার আগেই পোনা হঠাৎ করে মারা যেতে পারে। আবার বেলা ১২ টার পরে পোনা স্থানানত্মর করলে অতিরিক্ত রোদের তাপে কৈ মাছের পোনা সহজেই রোগে আক্রানত্ম হতে পারে।
পুকুর নির্বাচন : সাধারণত দো-অাঁশ, এটেল দো-অাঁশ এমনকি বেলে দো-অাঁশ মাটির পুকুর এবং যে সমসত্ম পুকুরে বন্যার পানি ওঠে না, পানির ধারণ ক্ষমতা বেশি সেই সমসত্ম পুকুরে কৈ মাছ চাষের উপযোগী। আয়তাকার পুকুরের আয়তন ৬০ থেকে ৮০ শতাংশের হলে ভাল। পানি পরিবর্তনের সুবিধা থাকতে হবে। পুকুরের গভীরতা ৪ থেকে ৫ ফুট হলে ভাল। অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে ৩ থেকে ৪ ফুট গভীরতার পুকুরেও এ মাছ চাষ করা যায়। সেক্ষেত্রে মাছের মজুদ ঘনত্ব একটু কম দিতে হবে।
পুকুর তৈরি : নতুন ও পুরাতন উভয় ধরনের পুকুরে কৈ মাছ চাষ করা যায়। নতুন পুকুরের তলায় শতাংশ প্রতি ১০ কেজি গোবর ছিটিয়ে তারপর হালকা চাষ দিতে হবে। তারপর অল্প একটু পানি দিয়ে ভাল করে মই দিতে হবে। পুরাতন পুকুর হলে প্রথমেই পুকুরের পানি সেচ দিয়ে শুকিয়ে ফেলতে হবে। তারপর সঁ্যাতসঁ্যাতে থাকা অবস্থায় শতাংশ প্রতি এক কেজি চুন পানির সাথে গুলে ছিটিয়ে দিয়ে ভাল করে মই দিতে হবে। এ সময় পুকুর শুকাতে দিতে হবে। পুকুরের তলার মাটি শুকিয়ে চৌচির হয়ে গেলে পুকুর চাষ করার উপযোগী হয়ে উঠবে। এ ছাড়া সারাবছর পানি থাকে এমন পুকুরেও কৈ মাছের চাষ করা যাবে। এক্ষেত্রে পুকুরে বিষটোপ বা রটেনন পাউডার দিয়ে অবাঞ্চিত বা রাক্ষুসে মাছ নিধন করতে হবে। তারপর শতাংশপ্রতি ১কেজি চুন পানির সাথে মিশিয়ে সমসত্ম পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে। সারাবছর অতিরিক্ত কাদা-পানি থাকে এমন পুকুরে কৈ মাছের চাষ না করাই ভাল। উলেস্নখিত পদ্ধতি অনুসরণ করে পুকুর তৈরির কাজ শেষ করতে হবে। এরপর পুকুরের পাড়ের উপর দিয়ে জাল দিয়ে ঘের দিতে হবে যাতে পুকুরের ভেতর সাপ, ব্যাঙ ঢুকতে পারে না। এ ছাড়াও মার্চ এপ্রিলে কৈ মাছ মজুদ করলে পুকুর থেকে মাছ উঠে যাওয়ার সম্ভবনা থাকে। মে মাস বা তারপরে কৈ মাছ মজুদ করলে পরবতর্ী ফেব্রম্নয়ারি পর্যনত্ম পুকুর থেকে উঠে যাওয়ার সম্ভবনা থাকে না। উলেস্নখিত পদ্ধতি অনুসরণের পর পুকুরে ২ ফুট পানি দিয়ে পোনা মজুদ করতে হবে।
মজুদ ঘনত্ব : প্রতি শতাংশে ৫০০ থেকে এক হাজারটি কৈ মাছ মজুদ করা যায়। যদিও কয়েক বছর আগে মজুদ ঘনত্ব শতাংশে ৩০০ দিয়ে শুরম্ন হয়েছিল। পানি পরিবর্তনের সুযোগের উপর মজুদ ঘনত্ব নির্ভরশীল। পানি পরিবর্তনের সুযোগ যত বেশি থাকবে কৈ মাছের মজুদ তত বেশি দেয়া যাবে। তবে মাছের মজুদ ঘনত্ব শতাংশে হাজারের বেশি দেয়া ঠিক নয়। (চলবে)
এ. কে এম. নূরম্নল হক
ব্রহ্মপুত্র ফিস সীড কমপেস্নক্স (হ্যাসারি)
চরপুলিয়ামারী, শম্ভুগঞ্জ, ময়মনসিংহ

হাইড্রোপনিক পদ্ধতি মাটিবিহীন চাষাবাদ

195881_1

গাছ আছে, ফল আছে, ফুল আছে আপনার প্রিয় আঙিনায়; কিন্তু গাছের নীচে মাটি নেই। ভাবছেন এটা আবার হয় নাকি! হয়। আপনার আঙিনায় মাটি ছাড়াই জন্মাবে প্রিয় ফসল, ফুল, সবজি। মাটির পরিবর্তে পানিতেই জন্মাতে পারবেন টমেটো, লেটুস, ফুলকপি, বাঁধাকপি, শসা, ক্ষিরা, ক্যাপসিকাম, স্ট্রবেরি, এ্যানথরিয়াম, গাঁদা, গোলাপ, অর্কিড, চন্দ্রমলিস্নকা আরো অনেক ফসল। মাটিবিহীন পানিতে ফসল উৎপাদনের এই কৌশলকে বলে হাইড্রোপনিক যা একটি অত্যাধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে সারাবছরই সবজি ও ফল উৎপাদন করা সম্ভব। এই চাষাবাদে কোনো কীটনাশক বা আগাছানাশক কিংবা অতিরিক্ত সার দেয়ার প্রয়োজন হবে না। তাই অনায়াসে গড়ে তুলতে পারবেন অর্গানিক ফসলের সম্ভার। সমপ্রতি বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) -এর বিজ্ঞানীরা এই প্রযুক্তিতে চাষাবাদ শুরম্ন করেছেন।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের ঊধর্্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এ.কে. এম. সেলিক রেজা মলিস্নক ১৯৯৭ সালে জাপানে হাইড্রোপনিক প্রযুক্তির উপর প্রশিক্ষণ নিয়ে এই প্রযুক্তি প্রথম বাংলাদেশে নিয়ে আসেন ২০০৬ সালে। ২০০৭ সালে তিনি বাংলাদেশের জলবায়ুর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হাইড্রোপনিক প্রযুক্তির গবেষণা শুরম্ন করেন টমেটো, ক্যাপসিকাম, লেটুস ও স্ট্রবেরি এই ৪টি ফসল নিয়ে। এ গবেষণায় সাফল্যের পর ২০০৮ সালে এর সাথে ক্ষিরা, শসা, গাঁদা ফুল ও বেগুন এবং ২০০৯ সালে বামন সিম, ফুলকপি, বাঁধাকপি, ব্রকোলি, চন্দ্রমলিস্নকা যোগ করেন। বিজ্ঞানী মলিস্নক এ গবেষণায় ব্যাপকভাবে সাফল্য পান।
তিনি জানান, লাভজনক ফসলের ক্ষেত্রে এ হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে মাটির পরিবর্তে পানিতে গাছের প্রয়োজনীয় খাবার সরবরাহ করে ফসল উৎপাদন করা হয়। জনবহুল দেশে যেখানে স্বাভাবিক চাষের জমি কম কিংবা নেই সেখানে ঘরের ছাদে বা আঙিনায়, পলি টানেল, নেট হাউজে হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে সবজি ও ফল উৎপাদন সম্ভব। উন্নত বিশ্বের যেমন : ইউরোপ, আমেরিকা, জাপান, তাইওয়ান, চীন, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহে বাণিজ্যিকভাবে হাইড্রোপনিক পদ্ধতির মাধ্যমে সবজি ও ফল উৎপাদন করা হচ্ছে। এই পদ্ধতিতে সারাবছরই সবজি ও ফল উৎপাদন করা সম্ভব এবং উৎপাদিত সবজি ও ফলে কোনো কীটনাশক ব্যবহার করা লাগে না বিধায় এ সবজি ও ফল নিরাপদ এবং অধিক বাজারমূল্য পাওয়া যায়।
সাধারণত দু'ভাবে হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করা যায়। সঞ্চালন পদ্ধতি এবং সঞ্চালনবিহীন পদ্ধতি।
সঞ্চালন পদ্ধতিতে গাছের অত্যাবশকীয় খাদ্য উপাদানসমূহ যথাযথ মাত্রায় মিশ্রিত করে একটি ট্যাংকিতে নেয়া হয় এবং পাম্পের সাহায্যে পাইপের মাধ্যমে ট্রেতে পুষ্টি দ্রবণ সঞ্চালন করে ফসল উৎপাদন করা হয়। প্রতিদিন অনত্মতপক্ষে ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা পাম্পের সাহায্যে এই সঞ্চালন প্রক্রিয়া চালু রাখা দরকার। এই পদ্ধতিতে প্রাথমিকভাবে প্রথম বছর ট্রে, পামপ এবং পাইপের আনুসাঙ্গিক খরচ একটু বেশি হলেও পরবর্তী বছর থেকে শুধুমাত্র রাসায়নিক খাদ্য উপাদানের খরচ প্রয়োজন হয়। ফলে দ্বিতীয় বছর থেকে খরচ অনেকাংশে কমে যায়। এ পদ্ধতিতে গ্যালভানাইজিং লোহার ট্রের উপর কর্কশিটের মাঝে গাছের প্রয়োজনীয় দূরত্ব অনুসারে যেমন_ লেটুস ২০ দ্ধ ২০ সে. মি. টমেটো ৫০ দ্ধ ৪০ সে. মি. এবং স্ট্রবেরি ৩০ দ্ধ ৩০ সে. মি. দূরত্বে গর্ত করতে হয়। উপযুক্ত বয়সের চারা স্পঞ্জসহ ওই গর্তে স্থাপন করতে হয়। অপরদিকে, সঞ্চালনবিহীন পদ্ধতিতে একটি ট্রেতে গাছের প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদানসমূহ পরিমিত মাত্রায় সরবরাহ করে সরাসরি ফসল চাষ করা হয়।
এই পদ্ধতিতে খাদ্য উপাদান সরবরাহের জন্য কোনো পাম্প বা পানি সঞ্চালনের প্রয়োজন হয় না। এক্ষেত্রে খাদ্য উপাদান মিশ্রিত দ্রবণ ও তার উপর স্থাপিত কর্কশিটের মাঝে ২ থেকে ৩ ইঞ্চি পরিমাণ জায়গা ফাঁকা রাখতে হবে। কর্কশিটের উপরে ৪ থেকে ৫টি ছোট ছোট ছিদ্র করে দিতে হবে যাতে বাতাস চলাচল করতে পারে এবং গাছ তার প্রয়োজনীয় অক্সিজেন কর্কশিটের ফাঁকা জায়গা থেকে সংগ্রহ করতে পারে। ফসলের প্রকার ভেদে সাধারণত ২ থেকে ৩ বার এই খাদ্য উপাদান ট্রেতে যোগ করতে হয়। আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ সহজেই এই পদ্ধতি অনুসরণ করে পস্নাস্টিক বালতি, পানির বোতল, মাটির পাতিল, ইত্যাদি ব্যবহার করে বাড়ির ছাদ, বারান্দা এবং খোলা জায়গায় সঞ্চালনবিহীন পদ্ধতিতে সবজি উৎপাদন করতে পারে। এতে খরচ তুলনামূলকভাবে অনেক কম হবে।
যে সকল ফসল হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করা যাবে তা হল_ পাতা জাতীয় সবজির মধ্যে লেটুস, গীমাকলমি, বিলাতি ধনিয়া, বাঁধাকপি। ফল জাতীয় সবজির মধ্যে টমেটো, বেগুন, ক্যাপসিকাম, ফুলকপি, শসা, ক্ষিরা, মেলন, স্কোয়াস, ফল স্ট্রবেরি, ফুল এ্যানথরিয়াম, গাঁদা, গোলাপ, অর্কিড, চন্দ্রমলিস্নকা, জারবেরা ইত্যাদি। হাইড্রোপনিক পদ্ধতির চারা উৎপাদন প্রসঙ্গে বিজ্ঞানী মলিস্নক বলেন, হাইড্রোপনিকস পদ্ধতিতে চারা উৎপাদনের জন্য স্পঞ্জ বস্নক ব্যবহার করা হয়। সাধারণত স্পঞ্জকে ৩০ সে. দ্ধ ৩০ সে. সাইজে কেটে নিতে হয়। এই স্পঞ্জকে ২.৫ সে মি. দৈঘর্্য এবং ২.৫ সে. মি. প্রস্থ বর্গাকারে, ডট ডট করে কেটে নিতে হয় এবং এর মাঝে এক সে. মি. করে কেটে প্রতিটি বর্গাকারে স্পঞ্জের মধ্যে একটি করে বীজ বপন করতে হয়। বীজ বপনের পূর্বে বীজকে ১০% ক্যালসিয়াম অথবা সোডিয়াম হাইপোক্লোরাইড দিয়ে বীজ শোধন করে নিতে হবে। বীজ বপনের পর স্পঞ্জকে একটি ছোট ট্রেতে রাখতে হবে। এই ট্রের মধ্যে ৫ থেকে ৮ সে. মি. পানি রাখতে হবে যাতে স্পঞ্জটি পানিতে সহজে ভাসতে পারে। চারা গজানোর ২ থেকে ৩ দিন পর প্রাথমিক অবস্থায় ৫ থেকে ১০ মি. লি. খাদ্য উপাদানে সম্বলিত দ্রবণ এক বার এবং চারা গজানোর ১০ থেকে ১২ দিন পর থেকে চারা রোপণের পূর্ব পর্যনত্ম প্রতিদিন ১০ থেকে ২০ মি. লি. দ্রবণ দিতে হবে। এ পদ্ধতিতে চারা রোপণের পর দ্রবণের পিএইচ মাত্রা ৫.৮ থেকে ৬.৫ -এর মধ্যে এবং ইসি মাত্রা ১.৫ থেকে ১.৯ -এর মধ্যে রাখা দরকার। গাছের বৃদ্ধির পর্যায়ে ওপর থেকে সুতা বা শক্ত রশি ঝুলিয়ে গাছ সোজা ও দাঁড় করিয়ে রাখতে হয় এবং পরিচর্যা সাধারণ গাছের মতই করতে হবে।
হাইড্রোপনিক পদ্ধতির জন্য রাসায়নিক দ্রব্যের পরিমাণ ও তৈরির প্রক্রিয়া একটু ভিন্ন রকম। প্রতি এক হাজার লিটার পানির জন্য পটাশিয়াম হাইড্রোজেন ফসফেট ২৭০ গ্রাম, পটাসিয়াম নাইট্রেট ৫৮০ গ্রাম, ক্যালসিয়াম নাইট্রেট এক হাজার গ্রাম, ম্যাগানেসিয়াম সালফেট ৫১০ গ্রাম, ইডিটিএ আয়রন ৮০ গ্রাম, ম্যাঙ্গানিজ সালফেট ৬.১০ গ্রাম, বরিক এসিড ১.৮০ গ্রাম, কপার সালফেট ০.৪০ গ্রাম, অ্যামনিয়াম মলিবটেড ০.৩৮ গ্রাম, জিংক সালফেট ০.৪৪ গ্রাম হারে পানিতে মিশিয়ে খাদ্য দ্রবণ তৈরি করতে হবে।
জলীয় খাদ্য দ্রবণ তৈরির সময় বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। প্রথমে ঝঃড়পশ ঝড়ষঁঃরড়হ তৈরি করতে হবে। এই ঝঃড়পশ তৈরি করার সময় ক্যালসিয়াম নাইট্রেট এবং ঊউঞঅ ওৎড়হ কে পরিমাপ করে ১০ লিটার পানিতে দ্রবীভূত করে দ্রবণকে ঝঃড়পশ ঝড়ষঁঃরড়হ "অ" নামে নামকরণ করতে হবে। অবশিষ্ট রাসায়নিক দ্রব্যগুলোকে একসাথে ১০ লিটার পাানিতে দ্রবীভূত করে ঝঃড়পশ ঝড়ষঁঃরড়হ "ইচ্ নামে নামকরণ করতে হবে। এক হাজার লিটার জলীয় দ্রবণ তৈরির ক্ষেত্রে প্রথমে এক হাজার লিটার পানি ট্যাংকে নিতে হবে। তারপর ঝঃড়পশ ঝড়ষঁঃরড়হ অ থেকে ১০ লিটার দ্রবণ ট্যাংকের পানিতে ঢালতে হবে এবং একটি অ-ধাতব দ-ের সাহায্যে নাড়াচাড়া করে ভালভাবে মেশাতে হবে। এরপর ঝঃড়পশ ঝড়ষঁঃরড়হ "ই" থেকে আগের মত ১০ লিটার দ্রবণ ট্যাংকে নিতে হবে এবং আগের মতই অ-ধাতব দ-ের সাহয্যে পানিতে ঝঃড়পশ ঝড়ষঁঃরড়হ গুলি সমানভাবে মেশাতে হবে।
হাইড্রোপনিক পদ্ধতির চাষাবাদের সুবিধা নিয়ে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক ড. মো. আব্দুল হক জানান, এ পদ্ধতিতে আবাদি জমির প্রয়োজন হয় না বিধায় সারাবছর কিংবা অমৌসুমেও সবজি, ফল, ফুল চাষাবাদ করা যায়। পদ্ধতিটি মাটিবিহীন চাষ পদ্ধতি হওয়ায় মাটিবাহিত রোগ ও কৃমিজনিত রোগ হয় না। কীটপতঙ্গের আক্রমণ কম হওয়ার কারণে এই পদ্ধতিতে কীটনাশকমুক্ত সবজি উৎপাদন করা সম্ভব। এই পদ্ধতিতে ছোট এবং বড় পরিসরে স্বাস্থ্যসন্মত এবং পরিচ্ছন্নভাবে ফসল উৎপাদন করা যায়। এটি হোম-ফার্মিং এর জন্য একটি আদর্শ প্রযুক্তি বিধায় অধিক লাভজনক, অর্থকরী ও মানসম্পন্ন ফসল উৎপাদন করা সম্ভব।
বিভিন্ন কারণে দেশে মাথাপিছু চাষযোগ্য জমির পরিমাণ সংকুচিত হচ্ছে। বর্ধিত জনসংখ্যার অব্যাহত খাদ্য চাহিদা পূরণের লৰ্যে শুধু আবাদি জমির উপর নির্ভর করা যাবে না। দেশের এমনি অবস্থায় প্রয়োজন অব্যবহৃত খালি জায়গা ও পতিত জায়গা শস্য চাষের আওতায় আনা। হাইড্রোপনিকস চাষ পদ্ধতি এ ৰেত্রে সঠিকভাবে আরোপযোগ্য একটি কৌশল। এ পদ্ধতি বাড়ির ছাদে, আঙিনায়, বারান্দায় কিংবা চাষের অযোগ্য পতিত জমিতে সহজেই চাষাবাদের আওতায় আনা সম্ভব। এতে করে একদিকে যেমন পতিত জমি বা অব্যবহৃত জায়গার সফল ব্যবহার হবে, অন্যদিকে দেশ অর্থনৈতিকভাবে অনেক লাভবান হবে।
লেখক : কৃষিবিদ, বৈজ্ঞানিক কর্মকতর্াফল গবেষণা কেন্দ্র, বিনোদপুর, রাজশাহী

হাইড্রোপনিক পদ্ধতি মাটিবিহীন চাষাবাদ

গাছ আছে, ফল আছে, ফুল আছে আপনার প্রিয় আঙিনায়; কিন্তু গাছের নীচে মাটি নেই। ভাবছেন এটা আবার হয় নাকি! হয়। আপনার আঙিনায় মাটি ছাড়াই জন্মাবে প্রিয় ফসল, ফুল, সবজি। মাটির পরিবর্তে পানিতেই জন্মাতে পারবেন টমেটো, লেটুস, ফুলকপি, বাঁধাকপি, শসা, ক্ষিরা, ক্যাপসিকাম, স্ট্রবেরি, এ্যানথরিয়াম, গাঁদা, গোলাপ, অর্কিড, চন্দ্রমলিস্নকা আরো অনেক ফসল। মাটিবিহীন পানিতে ফসল উৎপাদনের এই কৌশলকে বলে হাইড্রোপনিক যা একটি অত্যাধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে সারাবছরই সবজি ও ফল উৎপাদন করা সম্ভব। এই চাষাবাদে কোনো কীটনাশক বা আগাছানাশক কিংবা অতিরিক্ত সার দেয়ার প্রয়োজন হবে না। তাই অনায়াসে গড়ে তুলতে পারবেন অর্গানিক ফসলের সম্ভার। সমপ্রতি বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) -এর বিজ্ঞানীরা এই প্রযুক্তিতে চাষাবাদ শুরম্ন করেছেন।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের ঊধর্্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এ.কে. এম. সেলিক রেজা মলিস্নক ১৯৯৭ সালে জাপানে হাইড্রোপনিক প্রযুক্তির উপর প্রশিক্ষণ নিয়ে এই প্রযুক্তি প্রথম বাংলাদেশে নিয়ে আসেন ২০০৬ সালে। ২০০৭ সালে তিনি বাংলাদেশের জলবায়ুর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হাইড্রোপনিক প্রযুক্তির গবেষণা শুরম্ন করেন টমেটো, ক্যাপসিকাম, লেটুস ও স্ট্রবেরি এই ৪টি ফসল নিয়ে। এ গবেষণায় সাফল্যের পর ২০০৮ সালে এর সাথে ক্ষিরা, শসা, গাঁদা ফুল ও বেগুন এবং ২০০৯ সালে বামন সিম, ফুলকপি, বাঁধাকপি, ব্রকোলি, চন্দ্রমলিস্নকা যোগ করেন। বিজ্ঞানী মলিস্নক এ গবেষণায় ব্যাপকভাবে সাফল্য পান।
তিনি জানান, লাভজনক ফসলের ক্ষেত্রে এ হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে মাটির পরিবর্তে পানিতে গাছের প্রয়োজনীয় খাবার সরবরাহ করে ফসল উৎপাদন করা হয়। জনবহুল দেশে যেখানে স্বাভাবিক চাষের জমি কম কিংবা নেই সেখানে ঘরের ছাদে বা আঙিনায়, পলি টানেল, নেট হাউজে হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে সবজি ও ফল উৎপাদন সম্ভব। উন্নত বিশ্বের যেমন : ইউরোপ, আমেরিকা, জাপান, তাইওয়ান, চীন, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহে বাণিজ্যিকভাবে হাইড্রোপনিক পদ্ধতির মাধ্যমে সবজি ও ফল উৎপাদন করা হচ্ছে। এই পদ্ধতিতে সারাবছরই সবজি ও ফল উৎপাদন করা সম্ভব এবং উৎপাদিত সবজি ও ফলে কোনো কীটনাশক ব্যবহার করা লাগে না বিধায় এ সবজি ও ফল নিরাপদ এবং অধিক বাজারমূল্য পাওয়া যায়।
সাধারণত দু'ভাবে হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করা যায়। সঞ্চালন পদ্ধতি এবং সঞ্চালনবিহীন পদ্ধতি।
সঞ্চালন পদ্ধতিতে গাছের অত্যাবশকীয় খাদ্য উপাদানসমূহ যথাযথ মাত্রায় মিশ্রিত করে একটি ট্যাংকিতে নেয়া হয় এবং পাম্পের সাহায্যে পাইপের মাধ্যমে ট্রেতে পুষ্টি দ্রবণ সঞ্চালন করে ফসল উৎপাদন করা হয়। প্রতিদিন অনত্মতপক্ষে ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা পাম্পের সাহায্যে এই সঞ্চালন প্রক্রিয়া চালু রাখা দরকার। এই পদ্ধতিতে প্রাথমিকভাবে প্রথম বছর ট্রে, পামপ এবং পাইপের আনুসাঙ্গিক খরচ একটু বেশি হলেও পরবর্তী বছর থেকে শুধুমাত্র রাসায়নিক খাদ্য উপাদানের খরচ প্রয়োজন হয়। ফলে দ্বিতীয় বছর থেকে খরচ অনেকাংশে কমে যায়। এ পদ্ধতিতে গ্যালভানাইজিং লোহার ট্রের উপর কর্কশিটের মাঝে গাছের প্রয়োজনীয় দূরত্ব অনুসারে যেমন_ লেটুস ২০ দ্ধ ২০ সে. মি. টমেটো ৫০ দ্ধ ৪০ সে. মি. এবং স্ট্রবেরি ৩০ দ্ধ ৩০ সে. মি. দূরত্বে গর্ত করতে হয়। উপযুক্ত বয়সের চারা স্পঞ্জসহ ওই গর্তে স্থাপন করতে হয়। অপরদিকে, সঞ্চালনবিহীন পদ্ধতিতে একটি ট্রেতে গাছের প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদানসমূহ পরিমিত মাত্রায় সরবরাহ করে সরাসরি ফসল চাষ করা হয়।
এই পদ্ধতিতে খাদ্য উপাদান সরবরাহের জন্য কোনো পাম্প বা পানি সঞ্চালনের প্রয়োজন হয় না। এক্ষেত্রে খাদ্য উপাদান মিশ্রিত দ্রবণ ও তার উপর স্থাপিত কর্কশিটের মাঝে ২ থেকে ৩ ইঞ্চি পরিমাণ জায়গা ফাঁকা রাখতে হবে। কর্কশিটের উপরে ৪ থেকে ৫টি ছোট ছোট ছিদ্র করে দিতে হবে যাতে বাতাস চলাচল করতে পারে এবং গাছ তার প্রয়োজনীয় অক্সিজেন কর্কশিটের ফাঁকা জায়গা থেকে সংগ্রহ করতে পারে। ফসলের প্রকার ভেদে সাধারণত ২ থেকে ৩ বার এই খাদ্য উপাদান ট্রেতে যোগ করতে হয়। আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ সহজেই এই পদ্ধতি অনুসরণ করে পস্নাস্টিক বালতি, পানির বোতল, মাটির পাতিল, ইত্যাদি ব্যবহার করে বাড়ির ছাদ, বারান্দা এবং খোলা জায়গায় সঞ্চালনবিহীন পদ্ধতিতে সবজি উৎপাদন করতে পারে। এতে খরচ তুলনামূলকভাবে অনেক কম হবে।
যে সকল ফসল হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করা যাবে তা হল_ পাতা জাতীয় সবজির মধ্যে লেটুস, গীমাকলমি, বিলাতি ধনিয়া, বাঁধাকপি। ফল জাতীয় সবজির মধ্যে টমেটো, বেগুন, ক্যাপসিকাম, ফুলকপি, শসা, ক্ষিরা, মেলন, স্কোয়াস, ফল স্ট্রবেরি, ফুল এ্যানথরিয়াম, গাঁদা, গোলাপ, অর্কিড, চন্দ্রমলিস্নকা, জারবেরা ইত্যাদি। হাইড্রোপনিক পদ্ধতির চারা উৎপাদন প্রসঙ্গে বিজ্ঞানী মলিস্নক বলেন, হাইড্রোপনিকস পদ্ধতিতে চারা উৎপাদনের জন্য স্পঞ্জ বস্নক ব্যবহার করা হয়। সাধারণত স্পঞ্জকে ৩০ সে. দ্ধ ৩০ সে. সাইজে কেটে নিতে হয়। এই স্পঞ্জকে ২.৫ সে মি. দৈঘর্্য এবং ২.৫ সে. মি. প্রস্থ বর্গাকারে, ডট ডট করে কেটে নিতে হয় এবং এর মাঝে এক সে. মি. করে কেটে প্রতিটি বর্গাকারে স্পঞ্জের মধ্যে একটি করে বীজ বপন করতে হয়। বীজ বপনের পূর্বে বীজকে ১০% ক্যালসিয়াম অথবা সোডিয়াম হাইপোক্লোরাইড দিয়ে বীজ শোধন করে নিতে হবে। বীজ বপনের পর স্পঞ্জকে একটি ছোট ট্রেতে রাখতে হবে। এই ট্রের মধ্যে ৫ থেকে ৮ সে. মি. পানি রাখতে হবে যাতে স্পঞ্জটি পানিতে সহজে ভাসতে পারে। চারা গজানোর ২ থেকে ৩ দিন পর প্রাথমিক অবস্থায় ৫ থেকে ১০ মি. লি. খাদ্য উপাদানে সম্বলিত দ্রবণ এক বার এবং চারা গজানোর ১০ থেকে ১২ দিন পর থেকে চারা রোপণের পূর্ব পর্যনত্ম প্রতিদিন ১০ থেকে ২০ মি. লি. দ্রবণ দিতে হবে। এ পদ্ধতিতে চারা রোপণের পর দ্রবণের পিএইচ মাত্রা ৫.৮ থেকে ৬.৫ -এর মধ্যে এবং ইসি মাত্রা ১.৫ থেকে ১.৯ -এর মধ্যে রাখা দরকার। গাছের বৃদ্ধির পর্যায়ে ওপর থেকে সুতা বা শক্ত রশি ঝুলিয়ে গাছ সোজা ও দাঁড় করিয়ে রাখতে হয় এবং পরিচর্যা সাধারণ গাছের মতই করতে হবে।
হাইড্রোপনিক পদ্ধতির জন্য রাসায়নিক দ্রব্যের পরিমাণ ও তৈরির প্রক্রিয়া একটু ভিন্ন রকম। প্রতি এক হাজার লিটার পানির জন্য পটাশিয়াম হাইড্রোজেন ফসফেট ২৭০ গ্রাম, পটাসিয়াম নাইট্রেট ৫৮০ গ্রাম, ক্যালসিয়াম নাইট্রেট এক হাজার গ্রাম, ম্যাগানেসিয়াম সালফেট ৫১০ গ্রাম, ইডিটিএ আয়রন ৮০ গ্রাম, ম্যাঙ্গানিজ সালফেট ৬.১০ গ্রাম, বরিক এসিড ১.৮০ গ্রাম, কপার সালফেট ০.৪০ গ্রাম, অ্যামনিয়াম মলিবটেড ০.৩৮ গ্রাম, জিংক সালফেট ০.৪৪ গ্রাম হারে পানিতে মিশিয়ে খাদ্য দ্রবণ তৈরি করতে হবে।
জলীয় খাদ্য দ্রবণ তৈরির সময় বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। প্রথমে ঝঃড়পশ ঝড়ষঁঃরড়হ তৈরি করতে হবে। এই ঝঃড়পশ তৈরি করার সময় ক্যালসিয়াম নাইট্রেট এবং ঊউঞঅ ওৎড়হ কে পরিমাপ করে ১০ লিটার পানিতে দ্রবীভূত করে দ্রবণকে ঝঃড়পশ ঝড়ষঁঃরড়হ "অ" নামে নামকরণ করতে হবে। অবশিষ্ট রাসায়নিক দ্রব্যগুলোকে একসাথে ১০ লিটার পাানিতে দ্রবীভূত করে ঝঃড়পশ ঝড়ষঁঃরড়হ "ইচ্ নামে নামকরণ করতে হবে। এক হাজার লিটার জলীয় দ্রবণ তৈরির ক্ষেত্রে প্রথমে এক হাজার লিটার পানি ট্যাংকে নিতে হবে। তারপর ঝঃড়পশ ঝড়ষঁঃরড়হ অ থেকে ১০ লিটার দ্রবণ ট্যাংকের পানিতে ঢালতে হবে এবং একটি অ-ধাতব দ-ের সাহায্যে নাড়াচাড়া করে ভালভাবে মেশাতে হবে। এরপর ঝঃড়পশ ঝড়ষঁঃরড়হ "ই" থেকে আগের মত ১০ লিটার দ্রবণ ট্যাংকে নিতে হবে এবং আগের মতই অ-ধাতব দ-ের সাহয্যে পানিতে ঝঃড়পশ ঝড়ষঁঃরড়হ গুলি সমানভাবে মেশাতে হবে।
হাইড্রোপনিক পদ্ধতির চাষাবাদের সুবিধা নিয়ে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক ড. মো. আব্দুল হক জানান, এ পদ্ধতিতে আবাদি জমির প্রয়োজন হয় না বিধায় সারাবছর কিংবা অমৌসুমেও সবজি, ফল, ফুল চাষাবাদ করা যায়। পদ্ধতিটি মাটিবিহীন চাষ পদ্ধতি হওয়ায় মাটিবাহিত রোগ ও কৃমিজনিত রোগ হয় না। কীটপতঙ্গের আক্রমণ কম হওয়ার কারণে এই পদ্ধতিতে কীটনাশকমুক্ত সবজি উৎপাদন করা সম্ভব। এই পদ্ধতিতে ছোট এবং বড় পরিসরে স্বাস্থ্যসন্মত এবং পরিচ্ছন্নভাবে ফসল উৎপাদন করা যায়। এটি হোম-ফার্মিং এর জন্য একটি আদর্শ প্রযুক্তি বিধায় অধিক লাভজনক, অর্থকরী ও মানসম্পন্ন ফসল উৎপাদন করা সম্ভব।
বিভিন্ন কারণে দেশে মাথাপিছু চাষযোগ্য জমির পরিমাণ সংকুচিত হচ্ছে। বর্ধিত জনসংখ্যার অব্যাহত খাদ্য চাহিদা পূরণের লৰ্যে শুধু আবাদি জমির উপর নির্ভর করা যাবে না। দেশের এমনি অবস্থায় প্রয়োজন অব্যবহৃত খালি জায়গা ও পতিত জায়গা শস্য চাষের আওতায় আনা। হাইড্রোপনিকস চাষ পদ্ধতি এ ৰেত্রে সঠিকভাবে আরোপযোগ্য একটি কৌশল। এ পদ্ধতি বাড়ির ছাদে, আঙিনায়, বারান্দায় কিংবা চাষের অযোগ্য পতিত জমিতে সহজেই চাষাবাদের আওতায় আনা সম্ভব। এতে করে একদিকে যেমন পতিত জমি বা অব্যবহৃত জায়গার সফল ব্যবহার হবে, অন্যদিকে দেশ অর্থনৈতিকভাবে অনেক লাভবান হবে।
লেখক : কৃষিবিদ, বৈজ্ঞানিক কর্মকতর্াফল গবেষণা কেন্দ্র, বিনোদপুর, রাজশাহী

শুক্রবার, ১২ মার্চ, ২০১০

পেয়ারার ডাল বাঁকালেই ফলন দশগুণ! ফল ধরবে বারো মাস!

image_103_39321

ডাল বাঁকালেই ফলন দশগুণ। তা ছাড়া একই প্রযুক্তিতে বছরের বারো মাসই ফল ধরানো সম্ভব। ফলের মৌসুমে গাছের ফুল ছিঁড়ে দিয়ে এ প্রক্রিয়াকে আরো প্রভাবিত করা যায়, যার ফলে সারা বছরই ফলের মৌসুমের তুলনায়্র আট থেকে দশগুণ বেশি ফল ধরবে গাছে। পেয়ারা গাছের ক্ষেত্রে দীর্ঘ ২৭ মাস গবেষণার পর সম্পূর্ণ নতুন উদ্ভাবিত প্রযুক্তি সম্পর্কে এই তথ্য দিলেন বাউকুল উদ্ভাবক ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) কৃষিতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. এম এ রহিম।
উদ্ভাবিত প্রযুক্তি সম্পর্কে ড. রহিম কালের কণ্ঠকে বলেন, সাধারণত বর্ষা ও শীত_এই দুই ঋতুতে গাছে পেয়ারা হয়। তবে শীত অপেক্ষা বর্ষাকালে ফলন একটু বেশি হয়। বর্ষাকালে জলীয় ভাব বেশি থাকায় ফলের মিষ্টতা ও অন্য গুণাগুণ শীতকালের ফলের থেকে অনেকাংশেই কম থাকে। তা ছাড়া জলীয় ভাব বেশি থাকায় পাকা ফল তাড়াতাড়ি নষ্ট হয়ে যায়, ফলে দাম থাকে কম। কিন্তু পরীক্ষা করে দেখা গেছে, সব জাতের পেয়ারার গুণাগুণ শীতকালে বেড়ে যায়, রোগ ও পোকার আক্রমণও কম থাকে। ফলের আকৃতি এবং রং সব দিক থেকেই সুন্দর হওয়ায় এই সময়ে পেয়ারার দামও থাকে বেশি। এসব দিক বিবেচনায় রেখেই বর্ষাকাল বাদে কিভাবে অন্যান্য ঋতুতে অত্যধিক হারে উৎপাদন বাড়ানো যায় সে ব্যাপারে গবেষণা শুরু হয়। এ লক্ষ্যে ২০০৬ সালের সেপ্টেম্বর থেকে নিবিড় গবেষণার মাধ্যমে 'গাছের ডাল বাঁকানো' পদ্ধতি উদ্ভাবন করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্মপ্লাজম সেন্টারে এ পদ্ধতি প্রয়োগ করে প্রতিটি গাছ থেকে সাধারণের তুলনায় আট থেকে দশগুণ বেশি পেয়ারা উৎপাদন করা সম্ভব হয়েছে। এ ছাড়া পেয়ারার মৌসুমে গাছের ফুল ও ফল ছিঁড়ে দিয়ে এ প্রক্রিয়াকে আরো প্রভাবিত করা যায় বলে জানান তিনি।
এ প্রযুক্তির কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জার্মপ্লাজম সেন্টারের প্রধান গবেষণা সহযোগী কৃষিবিদ শামসুল আলম মিঠু কালের কণ্ঠকে বলেন, বছরে দুবার অর্থাৎ গ্রীষ্মকালে (এপ্রিল-জুন) এবং হেমন্তকালে (সেপ্টেম্বর-নভেম্বর) শাখা-প্রশাখার নিয়ন্ত্রিত বিন্যাসের মাধ্যমে সারা বছর পেয়ারার ফুল ও ফল ধারণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। গাছের বয়স দেড় থেকে দুই বছর হলেই এই পদ্ধতি শুরু করা যাবে এবং পাঁচ থেকে ছয় বছর পর্যন্ত এই পদ্ধতিতে ফলন বাড়ানো সম্ভব। ডাল বাঁকানোর ১০-১৫ দিন আগে গাছের গোড়ায় সার ও পানি দেওয়া হয়। ডাল বাঁকানোর সময় প্রতিটি শাখার অগ্রভাগের এক থেকে দেড় ফুট অঞ্চলের পাতা ও ফুল-ফল রেখে বাকি অংশ ছেঁটে দেওয়া হয়। এরপর ডালগুলোকে সুতা দিয়ে বেঁধে তা বাঁকিয়ে মাটির কাছাকাছি কাণ্ডের সঙ্গে অথবা খুঁটির মাধ্যমে মাটিতে বেঁধে দেওয়া হয়। গ্রীষ্মকালে মাত্র ১০ থেকে ১২ দিন পরই নতুন ডাল গজানো শুরু হয়। নতুন ডাল এক সেন্টিমিটার লম্বা হলে বাঁধন খুলে দেওয়া হয়। আর হেমন্তকালে নতুন ডাল গজাতে ২০ থেকে ২৫ দিন লাগে।
শামসুল আলম আরো বলেন, ডাল বাঁকানোর ৪৫ থেকে ৬০ দিন পরে ফুল ধরা শুরু হয়। এভাবে গজানো প্রায় প্রতি পাতার কোলেই ফুল আসে। তবে এ সময় টানা বৃষ্টি বা আর্দ্র আবহাওয়া ফলন বৃদ্ধিতে ক্ষতিকারক। এ পদ্ধতিতে সারা বছরই অত্যধিক হারে ফলন পাওয়া যায়। তা ছাড়া ফলের মিষ্টতা বেশি এবং রং ও আকৃতি সুন্দর হওয়ায় পেয়ারার বাজারদরও বেশি পাওয়া যায়।
এ ব্যাপারে ড. রহিম বলেন, এখন পর্যন্ত শুধু পেয়ারা গাছের ক্ষেত্রেই এ গবেষণা সম্পন্ন হয়েছে। তবে অন্য ফলের ক্ষেত্রেও গবেষণা চলছে। এই পদ্ধতি প্রয়োগ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্মপ্লাজম সেন্টারে গ্রীষ্মকালে গাছপ্রতি ৬০ থেকে ৭০ কেজি এবং হেমন্তকালে গাছপ্রতি ৫০ থেকে ৬০ কেজি পেয়ারার ফলন পাওয়া গেছে, যা স্বাভাবিকের তুলনায় আট থেকে দশগুণ বেশি। তিনি বলেন, কৃষকরা সহজেই এই পদ্ধতিতে পেয়ারা চাষ করে উৎপাদন বাড়াতে পারবেন, যা বাউকুলের মতো পেয়ারাকেও মানুষের কাছে সহজলভ্য করে তুলবে।

রবিবার, ৭ মার্চ, ২০১০

খাদ্য নিরাপত্তায় কৃষিপ্রযুক্তি

180100_1

স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে আজ পর্যন- জনসংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে। জমি কমেছে অথচ খাদ্যশস্য উৎপাদন বেড়েছে প্রায় তিনগুণ। প্রতিবছর এক শতাংশ হারে ৫০ হাজার হেক্টর আবাদি জমি কমে যাচ্ছে। অপরদিকে জনসংখ্যা প্রতি বছর ১.৫৪% হারে বাড়ছে। ক্রমহ্রাসমান জমি থেকে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা পূরণের জন্য দেশে বিদেশি হাইব্রিড বীজ আমদানি করে চাষাবাদ করা হচ্ছে। এর কারণে পরনির্ভরশীলতা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। দেশে গড়ে বছরে ১ লাখ টনের মত খাদ্যশস্য ঘাটতি থাকে। হাইব্রিড ফসল ছাড়াও নিচের প্রযুক্তি বা পদ্ধতিতে আমাদের খাদ্য ঘাটতি পূরণ সম্ভব :
জাত উদ্ভাবন : ফলন বেশি দেয়, খরা সহিষ্ণু, লবণাক্ততা সহিষ্ণু, বন্যা সহিষ্ণু, স্বল্প জীবনকাল ও পোকা-মাকড় রোগ প্রতিরোধীজাত উদ্ভাবন করা প্রয়োজন। ইতিমধ্যেই কিছু জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে।
আন-ঃফসল চাষাবাদ : একই জমিতে একই সাথে একাধিক ফসল চাষাবাদই হচ্ছে আন-ঃফসল চাষ। যেমন তুলা অথবা আখের সাথে পেঁয়াজ, আদা, রসুন, ডালজাতীয় শস্য, শাক-সবজি, তেলজাতীয় শস্য, গম ইত্যাদি চাষ করা যায়। ধানের জমিতে মাচা করে শাক-সবজি চাষ করা যায়।
মিশ্র ফসল চাষাবাদ : প্রধান ফসলের সাথে যে কোন একটি শস্য একই জমিতে একই সময়ে উৎপাদন করলে মিশ্র ফসল চাষ হবে। পাটের সাথে ডাঁটা, লালশাক, পুঁইশাক, ডালজাতীয় সবজি চাষ করা যায়। এতে একই জমি থেকে একই সাথে একই খরচে একাধিক ফসল পাওয়া যায়।
রিলে ফসল : কোন ফসল সংগ্রহ করার সাথে সাথে বিনা চাষে ডাল, শাক, ধনিয়া, ইত্যাদি স্বল্পকালীন সময়ে পরবর্তী ফসল চাষ শুরুর আগে চাষ করা যায়। সাধারণত আমন ধান কাটার পর বিনা চাষে ফসলের বীজ বপন করে রিলে ফসল উৎপাদন করা যায়।
রেটুন ফসল : প্রধান ফসল কাটার পর গাছের গোড়া থেকে কুশি গজায়। এই কুশি থেকে বিনাচাষে ও বিনা খরচে ফসল উৎপাদন করা যায়। আখ, কাঁকরোল, কলা ইত্যাদির মুড়ি ফসল উৎপাদন করা যায়।
ফসলের নিবিড়তা বৃদ্ধি : খাদ্যশস্য উৎপাদন বাড়াতে হলে ফসলের নিবিড়তা বাড়াতে হবে। বর্তমানে দেশে ফসলের নিবিড়তা ১৮০%। ২০ বছর আগে ছিল ১৬৬%। ফসলের নিবিড়তা বৃদ্ধির জন্য যে জমিতে বর্তমানে বছরে একটি ফসল হয় সে জমিতে দু'টি ফসল, যে জমিতে দু'টি সে জমিতে তিনটি এবং যে জমিতে তিনটি ফসল চাষ হয় এমন জমিতে চারটি ফসল উৎপাদন করতে হবে। এ জন্য স্বল্পজীবনকালের ফসলের জাত উদ্ভাবন করা প্রয়োজন। এ ছাড়াও সেচের আওতার জমি বাড়ানো, শস্য বিন্যাস ও শস্য পর্যায় অবলম্বন করা ও জমির উলম্ব ব্যবহার করা।
পতিত জমিতে চাষ : দেশে বর্তমানে ৭.৩ লক্ষ হেক্টর পতিত জমি রয়েছে। এরমধ্যে চাষযোগ্য পতিত জমি আছে ৩.২৩ লাখ হেক্টর। এসব পতিত জমিতে চাষাবাদের ব্যবস্থা করতে হবে। এসব ব্যক্তি মালিকানা পতিত জমিতে মালিক চাষাবাদ করতে পারে।
বাড়ির আঙিনায় চাষাবাদ : বসতবাড়ির আশেপাশে অনেক জায়গা পতিত থাকে। এসব জায়গায় শাক-সবজি, ভেষজ, ফুল ও ফল আবাদ করা যায়। এতে বাড়ির মালিক ও দেশ লাভবান হবে। দেশে বর্তমানে ১ কোটি ৭৮ লক্ষ ২৮ হাজার কৃষি পরিবার রয়েছে। বসতভিটা আছে ১ কোটি ১৮ লক্ষ। এসব বসতভিটার প্রতি ইঞ্চি জায়গায় চাষ করা সম্ভব।
পাহাড়ি এলাকায় চাষাবাদ : দেশের প্রায় ১৫ শতাংশ এলাকায় পাহাড় রয়েছে। অল্প জায়গায় জুম চাষ ও মশলা চাষ ছাড়া বাকি জমি অনাবাদি থাকে। এখানে সল্ট (ঝঅখঞ - ঝষড়ঢ়ঢ়রহম অমৎরপঁষঃঁৎধষ খধহফ ঞবপযহড়ষড়মু) পদ্ধতিতে ফসল চাষাবাদ করা যায়। এ পদ্ধতিতে বনজ, ফলদ ও রাবার বৃক্ষের পাশাপাশি শাক-সবজি চাষ, মাছ চাষ, পশুপালন করা সম্ভব।
লবণাক্ত এলাকায় চাষাবাদ : দেশের মোট আবাদি জমির ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ জমি লবণাক্ত। এসব জমিতে সাধারণত ফসল ভাল হয় না। তবে কিছু লবণাক্ততা সহ্য ক্ষমতাসম্পন্ন বিভিন্ন ফসলের জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। আরো কিছু জাত উদ্ভাবন করতে হবে। এ ছাড়াও লবণাক্ততা হ্রাসের পদ্ধতি প্রয়োগ করতে হবে।
চর এলাকায় চাষ : বাংলাদেশের নদীর পাড়ের এলাকায় শুধু বালুচর। এসব চরে ফসল বিন্যাস করে বালি মাটির উপযোগী ফসল যেমন, তরমুজ, বাদাম, আখ, সরিষা, ভুট্টা ইত্যাদি ফসল চাষাবাদ করতে হবে।
কৃষি বনায়ন : ফসলের জমিতে, বসতবাড়ির আশেপাশে, পুকুরের পাড়ে, নদী-নালা, খাল-বিলের পাড়ে মাছ, পশুপাখি ও ফসলের সাথে বৃক্ষ চাষাবাদ করা যায়।
উফশীজাতের চাষ : উচ্চ ফলনশীল জাতের ফসল চাষাবাদ করলে খাদ্যশস্য উৎপাদন বাড়বে। দেশে ৫৬টি জাতের ধানসহ সকল ফসলের উফশীজাত উদ্ভাবন করা হয়েছে।
শস্য বহুমুখীকরণ : দেশে ধান ছাড়া প্রায় দু'শতাধিক ফসল চাষাবাদের সুযোগ আছে। সব ধরনের ফসল চাষাবাদ করা উচিত। কারণ এতে ভাতের উপর চাপ কম পড়বে। পুষ্টির চাহিদা পূরণ হবে। মাটির উর্্বরতা বাড়বে। খাদ্যশস্যের উৎপাদন বাড়বে।
তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার : কল সেন্টার, রোগ নির্ণয়, পূর্বাভাস জানা, ঋণ ও পণ্য বিতরণ, কৃষি পণ্য ক্রয়-বিক্রয়, তথ্য প্রচার ইত্যাদি কাজ তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তির মাধ্যমে করলে ফসল উৎপাদন সহজ ও বেশি হবে।
প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার : দেশে প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে। এসব প্রাকৃতিক সম্পদ দেশের ফসল উৎপাদনে ব্যবহার করা যায়। যেমন- লতাপাতা, শাক-সবজির উচ্ছিষ্টাংশ, গাছের শাখাপ্রশাখা ইত্যাদি পচিয়ে জৈব সার তৈরি করা যায়। হাওর-বাঁওড়, পুকুর, ডোবার অব্যবহৃত জলাশয়ে মাছ চাষের ব্যবস্থা করতে হবে।
আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতি : নির্দিষ্ট দূরত্বে ফসল বপন/রোপণ করা, সুষম সার ব্যবহার, আগাছা দমন, সমকালীন চাষ, ভাল বীজ ব্যবহার, সেচ নিকাশ ইত্যাদি পদ্ধতিতে চাষ করলে ফলন বাড়ে।
জৈব প্রযুক্তি প্রয়োগ : আন-র্জাতিক জৈব প্রযুক্তি সম্মেলনে কৃষি বিজ্ঞানীরা বলেছেন, শুধু জৈব প্রযুক্তি দিয়ে অতিরিক্ত ৩ কোটি মেট্টিকটন খাদ্য উৎপাদন সম্ভব। জৈব প্রযুক্তির মাধ্যমে দ্রুত এবং প্রচুর চারা উৎপাদন করা যায়। এ ছাড়াও নতুনজাত উদ্ভাবন করে ফলন বৃদ্ধি করা সম্ভব।
সেচ প্রদান : দেশে মোট আবাদি জমির ৫৮% সেচের আওতায় আছে। বাকি ৪২% সেচের আওতায় আনতে হবে। সেচ দিলে ফলন ৩ থেকে ৪ গুণ বেশি হয়। যেমন গমে এক সেচ দিলে প্রতি হেক্টরে ২ টন ফলন হয়, তিনটি সেচ দিলে প্রায় ৪ টন ফলন হয়। এ রকম ধান, গোলআলু, শাক-সবজিসহ সব ফসলে সেচ দিলে ফলন বাড়ে।
ভাসমান পদ্ধতিতে চাষাবাদ : হাওর ও জলাবদ্ধ এলাকায় ভাসমান পদ্ধতিতে কচুরিপানার উপর সারা বছর সবজি চাষ করা যায়। ভাসমান পদ্ধতিতে ফসলের চারাও উৎপাদন করা যায়।
অন্যান্য পদ্ধতি : (১) খরা এলাকায় খরা সহিষ্ণু জাত ব্রিধান-৪৭ চাষ করা যেতে পারে। (২) চাষযোগ্য সমুদ্র উপকূলীয় এলাকায় শুষ্ক মৌসুমে পর্যাপ্ত স্বাদু পানির সরবরাহ নিশ্চিত করা। (৩) জাতীয় কৃষিনীতিতে কৃষিজমি ব্যবহারের আইন বাস-বায়ন করা। (৪) যেসব জমিতে সেচ ও কৃষি যন্ত্রপাতির অভাবে চাষ করা যায় না সে সব জমিতে বিনা চাষে (ডিবলিং পদ্ধতিতে) ফসল উৎপাদন করা। (৫) বন্যাপ্রবণ এলাকায় আগাম আউশের জাত চাষাবাদ করা (বিআর-২, বিআর-১৪, বিআর-২৬, ব্রিধান-২৭)। (৬) মঙ্গা এলাকার জন্য ব্রিধান-৩৩ ও বিনাধান-৭ চাষ করা। (৭) জমির আইলে শাক-সবজি, গো-খাদ্য, ডালজাতীয় শস্য ইত্যাদি চাষ করা। দেশে ১ লাখ ৪৪ হাজার হেক্টর জমির আইল হিসাবে প্রতিবছর চাষের বাইরে থাকে। (৮) উন্নত কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহার (৯) গুটি ইউরিয়া ও এলসিসি ব্যবহার (১০) প্রচুর পরিমাণে জৈব সার ব্যবহার (১১) খাল পুনখনন (১২) প্রিকাস্ট সেচ নালার সমপ্রসারণ (১৩) কৃষি আবহাওয়া কৃষকদের জানানো (১৪) লাভ বেশি এমন ফসল চাষাবাদ করা (১৫) শস্যবীমা চালু (১৫) বিনাসুদে ঋণ দেয়া (১৭) ভর্তুকি বৃদ্ধি ও সঠিক প্রয়োগ করা (১৮) কৃষি ক্লিনিক (১৯) কৃষি পরামর্শ কেন্দ্র জোরদার করা (২০) জলবায়ু পরিবর্তন উপযোগী ফসলের জাত ও প্রযুক্তি চিহ্নিত ও উদ্ভাবন করা। (জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় বাংলাদেশ সরকার ৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে।) (২১) কৃষি উপকরণ নিশ্চিত করা (২২) খাদ্যশস্য প্রক্রিয়াজাত, সংরক্ষণ, বাজারজাতকরণ সুষ্ঠু করা। (২৩) ফসলের পোকা-মাকড় ও রোগ-বালাই দমনে আইপিএম এর ব্যবহার (২৪) অর্গানিক খাদ্য উৎপাদনে জোর দেয়া। (২৫) ঘের পদ্ধতিতে ধান, মাছ, শাক-সবজি ও ফল উৎপাদনে জোর দেয়া। (২৬) খাদ্যাভাস পরিবর্তন করা।
উক্ত পদ্ধতিগুলো সারাদেশে বাস-বায়ন করার জন্য কৃষি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগ নিতে হবে। এ জন্য খাদ্য নিরাপত্তা বা ঋড়ড়ফ ঝবপঁৎরঃু একটি প্রকল্প করা যেতে পারে। প্রকল্পটি বাস-বায়ন করবে কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তর, গবেষণা প্রতিষ্ঠানসমূহ, কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন, কৃষি সংশ্লিষ্ট সকল প্রতিষ্ঠান। উক্ত পদ্ধতিগুলো বাস-বায়ন সম্ভব শুধু আন-রিকতা প্রয়োজন।
_কৃষিবিদ ফরহাদ আহাম্মেদ
টাঙ্গাইল

বাজারে আসছে বারিকুল_৩

kul 2

আমাদের দেশে বিভিন্ন মৌসুমে নানা রকম ফল উৎপাদন হয়ে থাকে। এগুলো রোগ প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ডাক্তাররা প্রায়ই বলে থাকেন, মৌসুমী ফল খেলে মৌসুমী রোগ-বালাইয়ের আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
দেশের হরেক রকম ফলের সমারোহে কুল অন্যতম। ভিন্ন স্বাদের, ভিন্ন ঢংয়ের কুলের সাথে এ দেশের মানুষ কম বেশি পরিচিত। গত কয়েক বছরে বারিকুল-১ ও ২, আপেলকুল, বাউকুল, তাইওয়ান কুল যেমন বাজার মাতিয়েছে তেমনি বারিকুল-৩ মাতাবে মানুষের মন। বড় বড় রসালো বারিকুল-৩ যে কারো নজর কেড়ে নিতে পারে।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএআরআই) এর রাজশাহীস্থ ফল গবেষণা কেন্দ্রে বারিকুল-৩ উদ্ভাবিত হয়। ফল গবেষণা কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত ও উধর্্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোঃ আলীম উদ্দীন জানান, এ জাতটির আদি উৎস হল থাইল্যান্ড। বারিকুল-৩ এর যে সমস- বৈশিষ্ট্য জাতটিকে অন্যান্য জাত করেছে তা হচ্ছে_ বারিকুল-৩ বেশ মিষ্টি, সাদা শাঁস এবং রসালো। গাছপ্রতি বারিকুল-৩ এর ফলন ৩৫-৪০ কেজি। প্রতিটি ফলের ওজন ৬০-৭৫ গ্রাম। এই কুলের মিষ্টতা (টিএসএস ১৪%) মাঝারী ধরনের হলেও এর বৃহদাকার আকৃতি যে কাউকে মুগ্ধ করতে পারে। এটি একটি বামন জাতের গাছ, ফলের শাঁস মচমচে এবং বাংলাদেশের সবগুলো কৃষি ভৌগলিক অঞ্চলে উৎপাদন যোগ্য। বারিকুল-৩ এর বীজ খুব ছোট এবং এই কুলের প্রায় ৯৬% খাদ্যোপযোগী। উচ্চ ফলনশীল এই বারিকুল-৩ হেক্টরপ্রতি প্রায় ১৪-১৫ টন ফলন দিতে সক্ষম।
ফল গবেষণা কেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোঃ শামীম আখতার জানান, বারিকুল-৩ থেকে ১ম বছরে ১৫-২০ কেজি প্রতি গাছে ফল পাওয়া যায়। পরবতর্ী বছরে ফলন আরো বাড়বে। তবে গাছের পরিচর্যা সঠিকভাবে করা হলে ফলন অনেক বেশি হবে। কোন কোন ক্ষেত্রে দ্বিগুণ ফলন পাওয়া যেতে পারে। প্রতি বছর বর্ষার আগে ও পরে জৈব ও রাসায়নিক সার প্রয়োগ করতে হবে। এটি চাষ করতে হবে স্কয়ার পদ্ধতিতে। প্রতি হেক্টরে ৪০০-৫০০ টি চারা রোপণ করলে ফলন ভাল পাওয়া যাবে। বপন থেকে কর্তন পর্যন- সময়কাল এক বছর। ১ম বছরে সম্ভাব্য উৎপাদন ৯-১৪ টন/হেক্টর। সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে ফুল আসে এবং জানুয়ারি মাসে বারিকুল-৩ পরিপক্ক হয়। এ ফলের জন্য উর্বর দো-অাঁশ মাটি উত্তম।
তবে বাংলাদেশের আবহাওয়ায় সব মাটিতেই এ ফল বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা যেতে পারে। এ কুল দীর্ঘ জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না। খরা মৌসুমে সেচপ্রদান করলে ভাল ফলন পাওয়া যাবে। এই কুলে রোগ ও কীট-পতঙ্গের আক্রমণ তুলনামূলকভাবে কম।
খুব শিগগিরই সারাদেশে বারিকুল-৩ ছড়িয়ে পড়বে বলে ফল গবেষণা কেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা আশাবাদী। কৃষকরাও বাণিজ্যিকভাবে এ কুল চাষ করে স্বাবলম্বী হতে পারবেন।
_গোকুল চন্দ্র বিশ্বাস, বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা
ফল গবেষণা কেন্দ্র, রাজশাহী