আবহমান বাংলার ঐতিহ্য পরিবেশবান্ধব তালগাছ চাষ করে চিনির আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে আনা সম্ভব। এতে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ের পাশাপাশি গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা হবে। ১০-১৫ বছর বয়স থেকে শুরু করে ৯০-১০০ বছর তালগাছ রস দিয়ে থাকে। এ রস খুবই মিষ্টি ও সুস্বাদু। জ্বাল দিয়ে উৎকৃষ্টমানের পাটালিগুড় ও মিছরি তৈরি করা যায়_ যা চিনির বিকল্প হিসেবে অত্যন- জনপ্রিয়। পাটালি গুড় ও মিছরি উৎপাদন করে একটি শিল্প সৃষ্টির মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলে বহু বেকারের কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে তালগাছ।
আমাদের দেশে সাধারণত দু'ধরনের তালগাছ দেখা যায়। গাছ স্ত্রী কিংবা পুরুষ প্রজাতির হয় এবং উভয় গাছই রস দেয়। তবে স্ত্রী প্রজাতির গাছে তাল এবং পুরুষ প্রজাতির গাছে তালের পরিবর্তে লম্বা গোলাকার এক প্রকার ছড়া বের হয়। যাকে স্থানীয় ভাষায় জট বলা হয়। প্রতিটি জট ও মোচা বিশেষ পদ্ধতিতে কেটে রস সংগ্রহ করা হয়।
পরিবেশ ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে তালগাছ রোপণ করা খুবই লাভজনক। এটি গুচ্ছমূলী বৃক্ষ বিধায় মাটি আটকিয়ে রেখে ভাঙন ও ভূমিক্ষয় রোধ করা ছাড়াও ঝড়-বৃষ্টি থেকে বাড়িকে রক্ষা করতে পারে। সহজ রোপণ প্রক্রিয়া, বিনা যত্নে উৎপাদন এবং বৃদ্ধির কারণে গ্রামীণ সড়ক, মহাসড়ক, বেড়িবাঁধ, জমির আইলে, অনাবাদি জমিতে তালগাছ রোপণ করা যায়। বিশেষভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, আবাদি জমিতে অন্যান্য সাধারণ প্রজাতির গাছ রোপণ করা না গেলেও তালগাছ খুব সহজেই রোপণ করা যায়। কারণ, তালগাছ ঊধর্্বমুখী বলে এটি খুব বেশি জায়গা দখল করে না। এর কোনা শাখা-প্রশাখা নেই বিধায় আবাদযোগ্য জমিতে আলো-বাতাস প্রবেশে বাধার সৃষ্টি করে না।
তালগাছ দীর্ঘজীবি উদ্ভিদের মধ্যে অন্যতম। গ্রাম বাংলার মানুষের কাছে অন্যরকম কদর রয়েছে মৌসুমী ফল তালের। একটি পূর্ণবয়স্ক তালগাছ গড়ে ৮০০ থেকে এক হাজার ফল দিয়ে থাকে। কাঁচা ও পাকা উভয় তালই বাঙালির প্রিয়। কাঁচা তালের শাঁস অত্যন- মুখরোচক। তালের রস ও পাকা তাল দিয়ে তৈরি হয় পিঠা, পায়েস, বড়া। পাকা তালের শাঁস খেতেও বেশ মজার। তালগাছ এমনই এক বৃক্ষ, যার সব অংশই কোন না কোন কাজে লাগে। তালপাতা দিয়ে সুন্দর হাতপাখা, পাতার শির দিয়ে টুপিসহ বিভিন্ন ধরনের হস-শিল্প তৈরি করা যায়। তালগাছের কাঠ অত্যন- শক্ত ও মজবুত হওয়ায় ঘর তৈরির খুঁটি, আড়া, রুয়া, বাটাম, কৃষকের লাঙলের ঈষ ও ডিঙ্গি নৌকা তৈরি করা হয়। ঘরের ছাউনি, ঝুঁড়ি, মাদুর এবং জ্বালানি হিসেবেও শুকনা তালপাতা ব্যবহৃত হয়।
আজ থেকে ১৫-২০ বছর আগে সারা দেশে হাজারো গাছের মধ্যে তালগাছ সারি বেঁধে আকাশে উঁকি মেরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যেত। কালের আবর্তে তালগাছ বর্তমানে অনেকটাই অস-িত্ব সংকটে পড়েছে। বৃক্ষ রোপণ অভিযানকালে আমরা অন্যান্য গাছ লাগালেও তালগাছকে এড়িয়ে যাই। অপরিকল্পিতভাবে তালগাছ কাটা এবং যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এখন আর মাঠের ধারে ও গ্রামীণ পথের পাশে সারি সারি তালগাছ চোখে পড়ে না। চোখে পড়ে না তালগাছে বাবুই পাখির বাসা বাঁধার মনকাড়া সেই দৃশ্য।
চৈত্র-বৈশাখ মাসে তালগাছ থেকে সুঘ্রাণ রস নিঃসৃত হয়। প্রতিটি গাছ থেকে দিনে ৩ বার রস সংগ্রহ করা হয়। প্রতিটি গাছের রস থেকে দিনে ২ কেজি গুড় পাওয়া যায়। অযত্নে অবহেলায় বেড়ে উঠলেও তালগাছ খাদ্য ও পুষ্টিসহ নানাভাবে অর্থনৈতিক সহযোগিতা করে আসছে।
পরিকল্পিতভাবে তালগাছের বনায়ন এবং পরিচর্যা করা গেলে যে পরিমাণ রস পাওয়া যাবে তা দিয়ে আধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে চিনি উৎপাদন করতে পারলে বিদেশ থেকে চিনি আমদানি কমিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করা যাবে।
রবিবার, ৭ মার্চ, ২০১০
হারিয়ে যাচ্ছে পরিবেশবান্ধব তালগাছ
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন