রবিবার, ৭ মার্চ, ২০১০

কম খরচে বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট আরডিআরএস উদ্ভাবিত

Baio gas plant

 

জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বিশ্ব ভারসাম্যহীনতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এর প্রভাবে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের ক্ষতিগ্রস- দেশের মধ্যে অন্যতম। বেশ কয়েক বছর ধরে গাছপালা লাগিয়ে সবুজ বেষ্টনী তৈরি করে পরিবেশ রক্ষা করার চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু বর্ধিত মানুষের চাহিদা মেটাতে কোনভাবেই গাছকে রক্ষা করা যাচ্ছে না। জ্বালানি সমস্যা মেটাতেই সবচেয়ে বেশি বন ধ্বংস হচ্ছে। গাছপালা কমে যাওয়াতে গ্রামের মানুষ জ্বালানির জন্য খুব বেশি নির্ভর হয়ে পড়ছে গোবরের উপর। এক সময় যে গোবরের একটা বড় অংশ কৃষিজমির উর্বরতায় ব্যবহার হত, এখন তার প্রায় সবটাই জ্বালানি হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এতে একদিকে যেমন বাতাসে কার্বন-ডাই অক্সাইডের পরিমাণ বাড়ছে, অন্যদিকে মাটির উর্্বরাশক্তি আশংকাজনকহারে কমে যাচ্ছে। এই অবস্থার থেকে পরিত্রাণ পেতে বায়োগ্যাস প্রযুক্তি বাস-বায়নে বিশ্বের অনেক দেশের মত বাংলাদেশও অগ্রণী ভূমিকা রাখছে।
সরকারি এবং বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা এই প্রযুক্তি বাস-বায়নে এগিয়ে আসছে। আরডিআরএস কয়েক বছর ধরে বায়োগ্যাস প্রযুক্তি জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রকল্পে বাস-বায়ন করে আসছে। গোবর থেকে বায়োগ্যাস প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে মানুষ একদিকে যেমন রান্না-বান্না করতে পারছে, বাল্ব জ্বালিয়ে আলোর ব্যবস্থা করতে পারছে; পাশাপাশি গোবর থেকে গ্যাস ব্যবহারের পর সেই গোবর (স্লারি) অত্যন- উন্নতমানের জৈব সার হচ্ছে, যা মাটির স্বাস্থ্য রক্ষায় বিশেষ ভূমিকা রাখছে।
বায়োগ্যাস প্ল্যান্টে মোট গোবরের ২৫-৩০ ভাগ দাহ্য গ্যাসে রূপান-রিত হয়। অবশিষ্ট ৭০-৭৫ ভাগ গোবর জৈব সার হিসাবে আহরণ করা যায়, যা তুলনামূলকভাবে সাধারণ গোবর সার থেকে উৎকৃষ্ট। বায়োগ্যাস প্ল্যান্টের গ্যাস ব্যবহারের পর যে গোবর সার বেরিয়ে আসে তা স্লারি (ভেজা গোবর) হিসাবে জমিতে ব্যবহার করলে জমিতে নাইট্রোজেনের কার্যকারিতা একশত ভাগ পাওয়া যায়। এই স্লারিতে (ভেজা গোবর সার) কোন গন্ধ থাকে না এবং মাছি বা পোকার উপদ্রব হয় না।
এই প্রযুক্তির সবচেয়ে বড় অসুবিধা হল এর নির্মাণ এবং বাস-বায়ন খরচ। একটি বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট স্থাপন করতে ২৫-৩০ হাজার টাকা খরচ হয় যা গ্রামের একটি গরিব পরিবারের পক্ষে বহন করা একেবারেই অসম্ভব। এর নির্মাণ খরচ কমানোর জন্য আরডিআরএস বাংলাদেশ গত কয়েক বছর ধরে নিরবাচ্ছিন্নভাবে গবেষণা করে আসছে এবং অত্যন- সফলভাবে মাত্র ১২ হাজার টাকার মধ্যে বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট বাস-বায়নে সমর্থ হয়েছে_ যা আডিআরএস মডেল বায়োগ্যাস নামে পরিচিত। আরডিআরএস প্রথমে বাজারের তৈরি সেনেটারি ল্যাট্রিনের জন্য নির্মিত রিং স্লাব দিয়ে ৪রিং বিশিষ্ট আরডিআরএস মডেল বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট তৈরি করে, যাতে মোট খরচ হয় ১৮ হাজার টাকা। এই প্ল্যান্টে সমপরিমাণ গ্যাস পাওয়া যায় যা বর্তমানে বেশ কয়েকজন কৃষকের বাড়িতে ব্যবহার হচ্ছে। আরো ব্যয়ভার কমানোর লক্ষ্যে পরবর্তিতে আরডিআরএস ২রিং বিশিষ্ট বায়োগ্যাস মডেল তৈরি করে। আরসিসি মালামাল দ্বারা নির্মিত এই বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট চার ফুট ব্যাসে তৈরি। সেক্ষেত্রে প্রতিটি বায়োগ্যাস প্ল্যান্টের জন্য খরচ হয় ১৭ হাজার টাকা। এই প্ল্যান্ট থেকেও সমপরিমাণ গ্যাস পাওয়া যায় যা চরাঞ্চলে কৃষকের বাড়িতে ব্যবহৃত হচ্ছে। পরবর্তিতে আরো ব্যয়ভার কমানোর লক্ষ্যে আরডিআরএস ১রিং বিশিষ্ট বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট তৈরি করতে সমর্থ হয়, যা তৈরিতে বর্তমান বাজারে খরচ হয় মাত্র ১২ হাজার টাকা। আরডিআরএস বর্তমানে এই প্ল্যান্ট চরাঞ্চলে জলবায়ুজনিত প্রকল্পে সমপ্রসারণ করছে। এই প্ল্যান্টের বিশেষত্ব হচ্ছে প্রতিটি প্ল্যান্ট ৬ ফুট ৮ ইঞ্চি ব্যাস যার গ্যাস ডোমও ৬ ফুট ৮ ইঞ্চি। এটি ফেরোসিমেন্ট মালামাল দিয়ে তৈরি। এই প্ল্যান্ট থেকেও একই পরিমাণ গ্যাস পাওয়া যায়। এই বায়োগ্যাস প্ল্যান্টের স্থায়ীত্বও বেশি। যেহেতু ১২ হাজার টাকার মধ্যে একই পরিমাণ গ্যাস পাওয়া যেতে পারে তাই এ রকম বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট স্থাপন সম্ভব হচ্ছে। আরডিআরএস উদ্ভাবিত প্রযুক্তি ব্যাপকভাবে এই বছর সমপ্রসারণ করবে। যাদের চারটি গরু আছে তারা ঋণের মাধ্যমে এই প্রযুক্তি নিজেদের বাড়িতে বাস-বায়ন করে বায়োগ্যাস দিয়ে রান্নাবান্না করে পরিবেশকে রক্ষা করতে পারবে। এতে বন উজাড় হবে না এবং কৃষিজমি দিন দিন উর্্বরতা শক্তি ফিরে পাবে। এছাড়াও এই প্রযুক্তি ব্যবহারে রাসায়নিক সারের উপর চাপ কমে আসবে এবং কৃষক কম খরচে অধিক ফসল ফলাতে পারবে।
কৃষিক্ষেত্রে বর্তমানে ৮০ ভাগ জমি চাষাবাদ হচ্ছে পাওয়ার টিলার দিয়ে। যার কারণে গ্রামগঞ্জে কৃষকের বাড়িতে গরু পালনের হার অনেক কমে গেছে। একটি বায়োগ্যাস প্ল্যান্টে প্রতিদিন ৪০ কেজি গোবরের প্রয়োজন হয়। সেক্ষেত্রে ৪-৫টি গরু থাকা প্রয়োজন। বেশিরভাগ কৃষকের বাড়িতে ৪-৫টি গরু নেই। সেদিক বিবেচনা করে আরডিআরএস গোবরের বিকল্প উৎস বের করতে গবেষণা করে একটি বড় ধরনের সাফল্য পেয়েছে। শুধু পচনশীল আবর্জনা (সবজি ও ফলমূলের অবশিষ্টাংশসহ ইত্যাদি পচনশীল দ্রব্য) থেকেও বায়োগ্যাস পাওয়া যায়। গবেষণায় দেখা গেছে ১২০ কেজি এরকম অবর্জনা দিয়েও কোন গোবর ছাড়াই একই পরিমাণ গ্যাস পাওয়া সম্ভব। পাশাপাশি কিছু গোবর এবং কিছু আবর্জনা দিয়েও (যেমন ৩০ কেজি গোবর এবং ৯০ কেজি আবর্জনা) একই পরিমাণ গ্যাস পাওয়া সম্ভব।
কম খরচে বায়োগ্যাস উৎপাদনের আরডিআরএস এর এই উদ্ভাবন বাংলাদেশের প্রত্যন- অঞ্চলের কৃষককে বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট বাস-বায়নে ব্যাপকভাবে উৎসাহিত করবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। এই প্রযুক্তি সমপ্রসারণে আরডিআরএস যে কোন সরকারি/বেসরকারি/দাতা সংস্থা/ব্যক্তিকে কারিগরী সহায়তা দিতে প্রস্তুত। আমরা আশা করি জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যায় আরডিআরএস উদ্ভাবিত এই মডেল ব্যাপক ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।
_এম জি নিয়োগী, হেড অব এগ্রিকালচার
আরডিআরএস বাংলাদেশ

1 টি মন্তব্য: